ইতিহাসে অর্থমন্ত্রীদের আলোচিত বাজেট বক্তব্য

বৃহস্পতিবার, ০৯ জুন ২০২২ | ৪:০১ অপরাহ্ণ

ইতিহাসে অর্থমন্ত্রীদের আলোচিত বাজেট বক্তব্য
apps

স্বাধীন বাংলাদেশে আজ ৫১তম বাজেট ঘোষণা হতে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগ সরকারের ২৩তম আর অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের চতুর্থ বাজেট এটি। বৃহস্পতিবার ৩টায় জাতীয় সংসদে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বাজেট পেশ করবেন অর্থমন্ত্রী।

করোনা সংকট এবং ইউক্রেন-রুশ যুদ্ধের মধ্যে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির মধ্যে এবারের বাজেট বাংলাদেশের জন্য চ্যালেঞ্জিং। একদিকে জিনিসপত্রের ঊর্ধ্বগতি, মুদ্রাস্ফীতি এবং অন্যদিকে করোনার কারণে থমকে যাওয়া উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের পরিস্থিতিতে নতুন বাজেট কীভাবে বাস্তবায়ন হবে সেদিকে দৃষ্টি নিবন্ধ দেশবাসীর। দেশের ১২তম অর্থমন্ত্রী হিসেবে মুস্তফা কামালের আজকের বাজেট বক্তৃতার দিকে বিশেষ দৃষ্টি থাকবে দেশবাসীর।

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল নিজেও বলেছেন, ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধে তিনি চাপবোধ করছেন। তবে সবশ্রেণির মানুষ যাতে উপকৃত হন, সেভাবে তিনি বাজেট প্রণয়ন করছেন। ছোট, মাঝারি ও বড় শিল্পোদ্যোক্তারা সবাই উপকৃত হবেন। সাধারণ মানুষের সাধ্যের মধ্যে থাকবে না— এমন কিছু বাজেটে চাপিয়ে দেবেন না বলে তিনি আশ্বস্ত করেছেন।

অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের ইতিহাসে গত ৫০ বছরে দেশের বাজেট অধিবেশনে একাধিক অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য নানা আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছিল। অনেকে প্রশংসা কুড়িয়েছেন। সেই সব অর্থমন্ত্রীর অনেকে না ফেরার দেশে চলে গেলেও তাদের কথামালা ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে রয়ে গেছে।

দেশের হয়ে সবচেয়ে বেশি বাজেট দিয়েছেন এম সাইফুর রহমান ও এমএ মুহিত। তারা প্রত্যেকে ১২ বার করে বাজেট দিয়েছেন। দেশের হয়ে প্রথম বাজেট বক্তৃতা করেন বঙ্গবন্ধু সরকারের অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। সাবেক অর্থমন্ত্রীদের আলোচিত কিছু বাজেট বক্তব্য পাঠকদের জন্য উপস্থাপন করা হলো।

তাজউদ্দিন আহমেদ
মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও পরবর্তী সময়ে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম অর্থনীতিবিদ হিসেবে ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে প্রথম বাজেট ঘোষণা করেন তাজউদ্দীন আহমদ। ওই সরকারের সময় তিনি তিন বার বাজেট ঘোষণা করেছিলেন।
১৯৭৩-৭৪ সালের বাজেট বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন, গত অর্থবছর ছিল আমাদের জাতীয় জীবনের এক কঠিন পরীক্ষা ও সুমহান আশার ফল।

১৯৭৪-৭৫ অর্থবছরের বাজেট বক্তব্যে তাজউদ্দীন আহমদ বলেছিলেন, সততা, নিয়মানুবর্তিতা, বাস্তবানুগ উন্নয়ন নীতি প্রণয়ন ও কঠোর পরিশ্রমের আজ বড় প্রয়োজন। এ কথা সবার মনে রাখা দরকার শুধু স্লোগান দিয়ে সমাজতন্ত্র কায়েম করা যায় না, দুর্নীতি দূর হয় না, শুধু বুলি আউড়িয়ে প্রবৃদ্ধি অর্জন করা যায় না। এতে শুধু সাধারণ জনগণকে সর্বকালের জন্য ধোঁকা দেওয়া চলে।

জিয়াউর রহমান
সেনাবাহিনীর তৎকালীন উপ-প্রধান ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ১৯৭৬-৭৭ অর্থবছরের বাজেট অধিবেশনে জিয়াউর রহমান বলেন, জাতি হিসেবে আমরা কেবল সঞ্চয় করাই শিখব না। আমাদের অপচয় করার প্রবণতাও পরিহার করা শিখতে হবে। সরকারি খাতের কতিপয় সংস্থার অতিমাত্রার অপচয় ও সম্পদের অপব্যবহার একটা গভীর উদ্বেগের কারণ হয়ে পড়েছে।

এম সাইফুর রহমান
১৯৯১-৯২ অর্থবছরের বাজেট বক্তব্যে এম সাইফুর বলেছিলেন, বিগত স্বৈরশাসনের আমলে দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নেয়। সরকারের অর্থ ব্যবস্থাপনা, বাজেট পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের সব বিধি ও নৈতিকতা ক্রমান্বয়ে ভেঙে পড়ে।

১৯৯২-৯৩ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় তিনি বলেন, আমাদের অর্থনীতি নিম্ন আয় ও নিম্ন প্রবৃদ্ধির আবর্তে বন্ধ হয়ে আছে। দীর্ঘদিন ধরে আমাদের প্রবৃদ্ধি অতি শীর্ণ ও উন্নতির পরিমাণ নগণ্য।

এম সাইফুর রহমান ১৯৯৩-৯৪ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় বলেন, পৃথিবীর কোনো দেশে সুদক্ষ বিনিয়োগকারী হিসেবে সরকারের নাম নেই। যেখানে সরকার একচেটিয়া বিনিয়োগের অধিকারী, সে ক্ষেত্রে এ কথা আরও সত্য।

এম সাইফুর রহমান ২০০৬-০৭ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা দেওয়ার মাধ্যমে সর্বাধিক ১২টি বাজেট ঘোষণা দেন।

শাহ এএমএস কিবরিয়া
১৯৯৭-৯৮ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় শাহ এ এম এস কিবরিয়া বলেছিলেন, অর্থনৈতিক সংস্কার কোনো দিনই সবাইকে সংশ্লিষ্ট করতে পারে না। কায়েমি স্বার্থে আঘাত না করে কোনো প্রকৃত সংস্কারই সম্ভব নয়।
২০০০-০১ অর্থবছরের বাজেট বক্তব্যে তিনি বলেন, এ সত্য কোনো প্রকারেই অস্বীকার করার উপায় নেই যে গত ৪ বছর ধরে বাংলাদেশের যে হারে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে এত উঁচুমানের প্রবৃদ্ধি বাংলাদেশে এর আগে কখনোই সম্ভব হয়নি। শাহ এম এস কিবরিয়া তৃতীয় সর্বোচ্চ ৬ বার বাজেট ঘোষণা দেন।

মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম
২০০৭-০৮ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এ অর্থ উপদেষ্টা বলেন, প্রশাসনিক দুর্বলতা ও রাজনৈতিক অস্থিরতা সত্ত্বেও সত্তরের দশকের প্রথমার্ধ থেকে এ পর্যন্ত সময়ের পরিক্রমায় বাংলাদেশের অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে।

আবুল মাল আবদুল মুহিত
২০০৯-১০ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় বলেন, দুঃখজনক হলেও সত্য দেশ ও জাতির অগ্রযাত্রা থেমে যায় ২০০১ সালে। বিএনপি জোট সরকার শাসিত এ সময়ে লাগামহীন দ্রব্যমূল্য ও সীমাহীন দুর্নীতি জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে তোলে। ২০১৩-১৪ অর্থবছরের বাজেট বক্তব্যে তিনি বলেন, আমি আসলে কর্মশক্তি পাই আমার প্রবল তথা শোভনীয় আশাবাদে।
সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ১৯৮২-৮৩ ও ১৯৮৩-৮৪ অর্থবছরের পরে ২০০৯-১০, ২০১০-১১, ২০১১-১২, ২০১২-১৩, ২০১৩-১৪, ২০১৪-১৫, ২০১৫-১৬, ২০১৬-১৭, ২০১৭-১৮ ও ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১০ বারসহ মোট ১২ বার বাজেট পেশ করেছেন।

আ হ ম মুস্তফা কামাল
বর্তমান অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১২তম দায়িত্বশীল ব্যক্তি হিসেবে তার প্রথম বাজেট পেশ করেন। অর্থমন্ত্রী প্রথমবারের মতো জাতীয় সংসদে ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট পেশ করার সময় হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে বাজেট বক্তৃতা পাঠ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম নজির।
২০২০-২১ অর্থবছরে ৫ লাখ ৬৮ হাজার টাকার বাজেট ঘোষণা হয়েছিল ১১ জুন। যা ছিল তার দ্বিতীয় বাজেট। মাত্র ৫০ মিনিটে শেষ হয় ২০২০-২১ অর্থ বছরের বাজেট উপস্থাপন। আগের সব বাজেট উপস্থাপনে অর্থমন্ত্রীর ৩ থেকে ৫ ঘণ্টার মতো লেগেছে। কিন্তু করোনা পরিস্থিতিতে সংক্ষিপ্ত পরিসরে বাজেট উপস্থাপন হয়। আর অধিবেশনও বাংলাদেশের ইতিহাসে সংক্ষিপ্ততম। মাত্র ৯ দিনের বাজেট আলোচনা ছিল।

২০২১-২২ অর্থবছরে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের তৃতীয় বাজেট এবং আওয়ামী লীগ সরকারের টানা তিন মেয়াদের ত্রয়োদশ বাজেট পেশ করেন। ওই বাজেট বক্তৃতা অর্থমন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে কোভিড ১৯-এর প্রাথমিক অভিঘাত মোকাবিলা করে বাংলাদেশ যখন অন্যান্য দেশের তুলনায় দ্রুতগতিতে অর্থনৈতিক উত্তরণের পথে এগিয়ে চলছিল, তখনই সারাবিশ্বে দ্বিতীয়, কোথাও কোথাও তৃতীয় অভিঘাত শুরু হয় এবং যার প্রভাব সর্বত্রই প্রবল। তাই আমাদের এবারের বাজেটেও দেশ ও জাতির উন্নয়নের পাশাপাশি প্রাধিকার পাচ্ছে দেশের পিছিয়ে পড়া মানুষ-প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ও তাদের জীবন জীবিকা।
এ ছাড়া অর্থমন্ত্রী হিসেবে বাজেট ঘোষণা দিয়েছেন এম সাঈদুজ্জামান, অধ্যাপক ড. ওয়াহিদুল হক, ড. এআর মল্লিক, ড. মির্জা নুরুল হুদা ও মেজর জেনারেল এম এ মুনেম। ১৯৯৫-৯৬ অর্থবছরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে অন্তর্বর্তীকালীন বাজেট দেন ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ।

সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন

Development by: webnewsdesign.com