অস্থির খুলনা বিএনপিতে ‘তুষের আগুন’ জলছে

বুধবার, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২ | ১:৪১ অপরাহ্ণ

অস্থির খুলনা বিএনপিতে ‘তুষের আগুন’ জলছে
apps

নজরুল ইসলাম মঞ্জু। খুলনা বিএনপির নামকরা নেতা। এক সময়ের সংসদ সদস্য এই নেতা ছিলেন মহানগর বিএনপির সভাপতি। খুলনার জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে মনিরুজ্জামান মনির নামডাকও কম নয়। এক সময়ের খুলনার এই নগরপিতা ছিলেন মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক। কেন্দ্রীয় বিএনপি গত ৯ ডিসেম্বর এক ঘোষণায় ছেঁটে ফেলে মঞ্জু-মনিকে। দেওয়া হয় তিন সদস্যের মহানগর ও জেলা আহ্বায়ক কমিটি। পদ হারানোর ‘ধাক্কা’ দু’জনের কেউই মানতে পারেননি। তাই গত ১২ ডিসেম্বর সংবাদ সম্মেলন ডেকে আহ্বায়ক কমিটি প্রত্যাখ্যান করে বসেন তারা। আর তাতেই আরও তেতে ওঠে কেন্দ্রীয় বিএনপি। ২৫ ডিসেম্বর নজরুল ইসলাম মঞ্জুর বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক পদটিও কেড়ে নেওয়া হয়।
এরপর থেকে মঞ্জু ও মনির অনুসারীদের মনে যে ক্ষত তৈরি হয়েছে, তা যেন কোনোভাবেই সারছে না। তাদের সেই ক্ষত এখন ‘তুষের আগুন’ হয়ে জ্বলছে। আহ্বায়ক কমিটি গঠনের পর থেকেই খুলনা বিএনপির সংকট আরও চড়েছে। দলে থেকেও নিষ্ফ্ক্রিয় মঞ্জু ও মনির অনুসারীরা।
বিএনপিসংশ্নিষ্ট অনেকে মনে করেন, এ কারণেই কেন্দ্রীয় কমিটির বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ আহ্বায়ক কমিটি গঠন করতে পারেনি খুলনা মহানগর ও জেলা বিএনপি। তবে নতুন আহ্বায়ক কমিটি নগরের পাঁচটি থানা, ৩১টি ওয়ার্ড ও তিনটি ইউনিয়নে বিএনপির পূর্ণাঙ্গ কমিটি ভেঙে দিয়েছে। দলের নেতাকর্মীদের নিজেদের দিকে ভেড়ানোর চেষ্টা করেও সফল হতে পারছেন না নতুন পদধারী শীর্ষ নেতারা। এ নিয়ে দলের মধ্যে তৈরি হয়েছে অস্থিরতা।
দলীয় সূত্রে জানা যায়, কেন্দ্রীয় কমিটি ১৪ ডিসেম্বর চিঠি দিয়ে ১৫ দিনের মধ্যে মহানগর ও জেলায় ৫১ সদস্যের দুটি পূর্ণাঙ্গ আহ্বায়ক কমিটি গঠনের নির্দেশনা দেয়। সে সময় পেরিয়ে গেলেও মহানগর ও জেলা বিএনপি এখনও পূর্ণাঙ্গ আহ্বায়ক কমিটি তৈরি করতে পারেনি।
তিন সদস্যের খুলনা মহানগর কমিটিতে রয়েছেন আহ্বায়ক শফিকুল আলম মনা, যুগ্ম আহ্বায়ক তারিকুল ইসলাম জহির এবং সদস্য সচিব শফিকুল আলম তুহিন। অন্যদিকে জেলা কমিটিতে রয়েছেন আহ্বায়ক আমির এজাজ খান, যুগ্ম আহ্বায়ক আবু হোসেন বাবু এবং সদস্য সচিব মনিরুল হাসান বাপ্পী।
মঞ্জুকে কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়ার প্রতিবাদে ২৫ ডিসেম্বর পদত্যাগ করেন তার বলয়ের ১৬ নেতাকর্মী। ২৬ ডিসেম্বর খুলনা সদর ও সোনাডাঙ্গা থানা, ওয়ার্ড বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের ৫৬১ নেতাকর্মীও পদত্যাগ করে প্রতিবাদ জানান। ২৬ ডিসেম্বর দৌলতপুর থানা বিএনপি, পাঁচটি ওয়ার্ড ও একটি ইউনিয়নের সব অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় মঞ্জুর বিষয়ে সিদ্ধান্ত না পাল্টানো পর্যন্ত নেতারা রাজনীতিতে নিষক্রিয় থাকার ঘোষণা দেন। তারা এখনও সেই সিদ্ধান্তে অটল।

২৭ ডিসেম্বর নগরীর খালিশপুর থানা ও সেখানকার ৯টি ওয়ার্ড বিএনপি এবং অঙ্গসংগঠনের ২৭৮ নেতাকর্মী পদত্যাগ করেন। ২৮ ডিসেম্বর মৎস্যজীবী দলের ৪৫ জন, ওলামা দল ও জিয়া শিশু কিশোর সংগঠনের ৫৫ নেতাকর্মী পদত্যাগ করেন। ২৯ ডিসেম্বর খানজাহান আলী থানা বিএনপি, দুটি ইউনিয়ন ও একটি ওয়ার্ড বিএনপির সভায় মঞ্জুর বিষয়ে নতুন সিদ্ধান্ত না আসা পর্যন্ত নেতাকর্মীরা রাজনীতিতে নিষক্রিয় থাকার কৌশল নেন।
গত দুই মাসে নতুন আহ্বায়ক কমিটি বেশ কয়েকটি সভাসহ দলীয় অন্যান্য কর্মকাণ্ড করেছে। ওই কর্মসূচিতে মঞ্জু-মনি বলয়ের বেশিরভাগ অনুসারীকেই অংশ নিতে দেখা যায়নি। সূত্র জানিয়েছে, নতুন আহ্বায়ক কমিটির নেতারা বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা আজিজুল বারী হেলাল (খুলনায় বাড়ি) ও খুলনা-৩ আসনে ধানের শীষ নিয়ে নির্বাচন করা রকিবুল ইসলাম বকুলের অনুসারী।

দৌলতপুর থানা বিএনপির সদ্য সাবেক সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল হক নান্নু বলেন, ‘আমরা মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি পুনর্গঠন ও ত্যাগী নেতাকর্মীদের মূল্যায়নের জন্য আলটিমেটাম দিয়েছিলাম। আমাদের দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত কোনো নেতাকর্মী দলীয় কর্মকাণ্ডে অংশ নেব না।’
অন্যদিকে বসে নেই মহানগর বিএনপির নতুন আহ্বায়ক কমিটিও। তারা নিয়মিত দলীয় কর্মকাণ্ড করছেন এবং মঞ্জু-মনি বলয়ের অনুসারীদের তাদের দিকে ভেড়ানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এরই মধ্যে মঞ্জু-মনি পক্ষের হাতেগোনা কয়েকজন নেতাকর্মী নতুন আহ্বায়ক কমিটির দিকে ঝুঁকেছেন।
গত ২৫ ডিসেম্বর মহানগর বিএনপি নগরীর পাঁচটি থানা কমিটি বিলুপ্ত করে। এ ছাড়া গত ১৩ ফেব্রুয়ারি নগরীর ৩১টি ওয়ার্ড এবং তিনটি ইউনিয়ন বিএনপির কমিটি বিলুপ্ত করা হয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সোনাডাঙ্গা থানা বিএনপির এক নেতা বলেন, মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি থানা ও ওয়ার্ডের কমিটি বিলুপ্ত করে নতুন আহ্বায়ক কমিটি গঠনের চেষ্টা করা হচ্ছে। তারা মঞ্জু-মনি পক্ষের নেতাদের পদ দেওয়ার লোভ দেখিয়ে তাদের দিকে ভেড়ানোর চেষ্টা করছে। তবে তারা কেউ সেই প্রলোভনে পড়ছে না।

এদিকে বিএনপি নেতা হেলাল ও বকুলকে ইঙ্গিত করে নজরুল ইসলাম মঞ্জু বলেন, একটি সিন্ডিকেট কেন্দ্রীয় নেতাদের ভুল বুঝিয়ে আমাকে দুটি পদ থেকে সরিয়ে দিয়েছে। এটা অবিচার। কেন্দ্রীয় নেতাদের আমি বিষয়টি জানিয়েছি। খুলনা বিএনপির একটি প্রতিনিধি দল শিগগির ঢাকায় গিয়ে কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে দেখা করে সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরবে। তিনি আরও বলেন, ‘যাদের দলের নেতৃত্বে আনা হয়েছে, তাদের সঙ্গে নেতাকর্মী নেই। তারা কোনো আন্দোলন-সংগ্রামই সফল করতে পারবে না। তখন দল সবচেয়ে বড় সংকটে পড়বে।’

তবে মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব শফিকুল আলম তুহিন জানান, পূর্ণাঙ্গ আহ্বায়ক কমিটি গঠনের জন্য তারা কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছ থেকে কিছুদিন সময় চেয়ে নিয়েছেন। শিগগির তারা সভা করে পূর্ণাঙ্গ আহ্বায়ক কমিটি গঠনের পর অনুমোদনের জন্য কেন্দ্রে পাঠাবেন। তিনি বলেন, থানা ও ওয়ার্ড কমিটিগুলোর মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ায় বিলুপ্ত করা হয়েছে। জেলা বিএনপির সদস্য সচিব মনিরুল হাসান বাপ্পী বলেন, আহ্বায়ক কমিটি গঠনের পর থেকে একের পর এক দলীয় কর্মসূচি হচ্ছে। সে কারণে আহ্বায়ক কমিটি গঠনের জন্য সভা করার সময় পাওয়া যায়নি। কিছু দিনের মধ্যেই পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা হবে। বিএনপি নেতা রকিবুল ইসলাম বকুল বলেন, ‘কারও পদত্যাগে বিএনপি থেমে থাকবে না। বিএনপি তার গতিতেই এগিয়ে যাবে। তবে দুঃসময়ে দলের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়ানো উচিত নয়।’

Development by: webnewsdesign.com