প্রথমলেনের নিচতলার ভাড়াটিয়া। পৃথিবীর বৃহত্তম কলেজে পড়ি। শহরের আনাচে-কানাচে আমাদের সহাপাঠী প্রিয়জনে গিজগিজ করে। পাশের সিটে যে ভাই ঘুমায়, তিনি একটা স্কুলে হিসাববিজ্ঞান পড়ান। জ্বর-জারি কিংবা জরুরি প্রয়োজনে আমি তাঁর হয়ে প্রক্সি দিই। নাইন-টেনের বাচ্চা মেয়েরা খুব আবেগপ্রবণ, এই কথা বলে মাস্টারমশাই আমাকে প্রায় ক্লাশে পাঠিয়ে ডেটিংয়ে যেতেন। আমার তখনো শহর নিজস্ব হয়ে ওঠেনি। গ্রামগন্ধ নিয়ে নিজের ক্লাস ফাঁকি মেরে হাইস্কুলে প্রক্সি দিয়ে প্রশংসা কুড়াই। দৃশ্যমান কোন উপহার তখনো কপালে জোটেনি। একরাতে ঘুমোবার আগে একটা গন্ধরাজ পেলাম। পরের রাতে বেলী এরপর রজনীগন্ধা, ডালিয়া, বকুল, গোলাপ। পছন্দের ফুলগুলো কে রেখে যায়! নাম পরিচয় জানাতে কেন এতো আপত্তি? বন্ধুরা মজাচ্ছলে ট্রিট নিতে চায়। রহস্য ভালোবাসি। বললাম, বাগানে এখনো অনেক ফুল। আগেতো ফুটতে দাও। রোজ একটা করে ফুল আসে। সপ্তাহ গড়িয়ে মাস চলে যায়। ফুল রাখতে কাউকে দেখা যায় না। রুমমেটরা এক প্রকার অভ্যস্ত হয়ে যায়। কিন্তু ফুল রাখনেওয়ালা নিয়ে আড়ালে আবডালে কানাঘুঁষা চলতে
থাকে। দুই তিন কান মুখ হয়ে আমার কাছে প্রতিধ্বনিত হয়। দোতলায় তখন রূপশ্রী চক্রবর্তী নামে মহল্লার যুব সম্প্রদায়ের গুপ্ত প্রেমের জীবন্ত দেবীরা পুরো পরিবার নিয়ে থাকতেন। তাঁর মায়ের সঙ্গে আমাদের ভাই-বোন সম্পর্ক। সামনাসামনি দেখায় আঙ্কেল বললে মেজাজ খারাপ হতো ঠিক কিন্তু পুজোয় নাড়–-মোয়ার তুষ্ট হয়ে যেতাম।
আরো পড়ুন: মৌরিতানিয়া : জামিল জাহাঙ্গীর
তাঁকে সন্দেহ করা আমার বন্ধুদের সাথে আমি কখনোই একমত হইনি। কিন্তু চারতলা বাড়ির ষোলটি ফ্ল্যাটের অনেকেই মাগনা ফুলের সুবাস নিতে থাকলো। এপার্টম্যান্ট প্রাচীরের ফুটো পেরিয়ে সেই সুবাস পাড়ার বিনোদনে যোগ করে দিলো বাড়তি শিহরণ। গুপ্ত জুলিয়েট নিয়ে এক অচেনা রোমিও হয়ে মহল্লার মুজরায় পরিণত হলাম আমি। চা দোকানী বিল নেয় না, লন্ড্রীওয়ালা ফ্রিতে কাপড় ধুয়ে ইস্ত্রী করে দেয়। হোটেলে তিনহাজার টাকার উপরে বাকি পড়ে আছে তবুও হাত ধুয়ে বসলেই গরমভাত। ডাক পড়লো বাড়িওয়ালির দরবারে। তিনি বললেন, দেখো ভাই আমি চার চারটি মেয়ে নিয়ে বসবাস করি। একেতো বিধবা তার ওপর
তোমরা আমার বাড়িটাকে প্রেমবাগান বানিয়ে ছাড়লে আমি পথে বসবো। প্লিজ সামনের মাস থেকে অন্য কোথাও বাসা খুঁজে নাও। বললাম, ভাবী আপনার মেয়েরা আমাদের মেয়ের মতো। তারা আমাদের সম্মান করে। আর আমাদের মধ্যে কেউ প্রেম-পিরিতের সঙ্গে জড়িত নই। আমাদের বাসা ছাড়ার নোটিশ দিতেই পারেন কিন্তু মিথ্যা অপবাদ দিয়ে কেন! তিনি তখন সরাসরি বললেন, তোমার জানালায় প্রতিদিন ফুল দেয় কে? হেসে উঠে বললাম, ও এই কথা, ফুল আমার খুব পছন্দের। নাম প্রকাশ না করে যে দিয়ে যায় তাকে আমিও খুঁজছি। শুনেছি সন্ধ্যার সময় রেখে যায়। এসময় আমরা কেউ বাসায় থাকি না। সন্ধ্যার দিকে একটু খেয়াল রাখলে খুব সহজেই বের করা যাবে। এমন কাজ কার। তোমার কাউকে সন্দেহ হয়? বললাম, না। সন্দেহ পৃথিবীর সবচেয়ে পুরনো রোগ। আমার যেন এ রোগ না হয়। এরপর বললেন, কোন কৌতূহলও নেই?
আরো পড়ুন: জলের জঙ্গলে : জামিল জাহাঙ্গীর
আছে। তবে এটাও জানি কৌতূহল ফুল প্রাপ্তি থামিয়ে দিতে পারে। তিনি বললেন, আমার ধারণা দোতলার দিদির ধুমসিটা ছাড়া এ কাজ করতে বাইরে থেকে কেউ আসবে না। বললাম, দোতলার দিদি আমাদের ভাইয়ের মতো স্নেহ করে। তাঁর ছেলে আমার কাছে পড়ে। বাড়িওয়ালী বললো, মেয়েটা তাইলে এমনি এমনি তোমার বাসায় যায়? তার ভাই আমার কাছে পড়ে, সেও পড়তে চায়, আমার সময় কম বিধায় পারি না। বাদ দিন ওসব আমি সিওর রূপা এ কাজ করে না। নিত্য নতুন ফুল সে কোথায় পাবে? আপনি সন্ধ্যার দিকে একটু খেয়াল রাইখেন, আশা করছি বুঝতে পারবেন ফুলের উৎস। এরপর কি ঘটলো জানি না। বাড়িওয়ালী আমার সঙ্গে
কথা বলা বন্ধ করে দিলো। আমার রুমমেটরা আড়ালে আবডালে কানাঘুষাঁর পরিমাণ বাড়িয়ে দিল। একজন আমাকে বাড়ি চলে যাবার পরামর্শ দিয়ে দিলো। ফুলের প্রাপ্তি আগের মতোই চলছে। রূপার কাছেই জানলাম ফুল বাগানের দিক। মহল্লার মাস্তান পরিবারের মেয়ে। পলিটিকাল ফিল্ডে পারফর্ম করার কারণে যাকে সবাই ভয় পায় সে ই ফুল দেনেওয়ালী। নির্বাচনে বন্ধুদের সঙ্গে প্রচারনায় কাজ করেছি। ওই মেয়েও দলে ছিলো। দেড় দুই মাসের কাজে বেশ কবার দেখা সাক্ষাৎ এবং কাজের সম্পর্ক। কিন্তু হৃদয়ঘটিত কোন বিষয় মনে পড়লো না। সম্ভবত একবার আমি তাঁর নামের প্রশংসা করেছি। নাম সুন্দর হলে আমি কি বলবো অসুন্দর! পরের সপ্তায় লেগে গেল ক্যাচাল। আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু রেললাইনে নিয়ে লোডেড পিস্তল ধরে বললো, অতন্দ্রীর সাথে তোর কি সম্পর্ক? হেসে বললাম, মেশিন নামা। বিষয়টি আমারও জানা দরকার। শুনেছি সে আমার জানালায় ফুল রেখে যায়। আমরা দু‘জন মিলে তাদের বাসায় যাই। দু‘জনকে একসাথে দেখে ওরা ঘাবড়ে গেল। ওর ভাবি আমাদের শান্ত হয়ে বসতে বললো। অতন্দ্রী নিজেও এলো আমাদের আপ্যায়ন করতে।
আমরা কথা বলছি, বাইরে বেশ ক’জন ক্যাডার। সবার সঙ্গেই কিছু না কিছু অস্ত্র। সরাসরি তাঁকে বললাম, যে চুরি করে ফুল দেয় সে নিতান্তই চোর। আর যে তীব্র ভালোবাসে সে প্রেমিক। আমার বন্ধু আপনাকে ভালোবাসে তাই এরপর ফুল ফুটলে সবগুলো তার। গল্পটা এখানে শেষ হলেই ভালো হতো। কিন্তু ভালোমন্দের সাথে গল্পের সমাপ্তির কোন সম্পর্ক নেই। সে লতার মতোই জীবন বেয়ে বেয়ে সমুদ্রগামী…
আরো পড়ুন: বিরাট বেহেস্তের বাজার : জামিল জাহাঙ্গীর
Development by: webnewsdesign.com