বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রী জাতীয় চার নেতার অন্যতম শহীদ এ এইচ এম কামারুজ্জামানের প্রিয়তমা স্ত্রী জাহানারা জামান। ২০১৭ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাতে এই সংগ্রামী নারীর জীবনাবসান ঘটে।
জমিদারবাড়ির বড় বউ ছিলেন জাহানারা জামান । পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টে তিনি ছিলেন সরকারি বাসায়। তবে বাসা ছাড়ার নোটিশ দেওয়ার আগেই তিনি ছেড়ে দিয়েছিলেন সেই বাসা। উঠলেন ভূতের গলির একটি ছোট বাসায়।
মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি অন্যতম নারী সংগঠক রূপে আত্ম প্রকাশ ঘটে। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী দেশের নিরীহ মানুষের জন্য খাবার যোগান দিতেন এ মহীয়সী নারী। লেখালেখি ছিলো তার নিত্যদিনের সঙ্গী।
এরপর ৩ নভেম্বর ১৯৭৫, জীবনসঙ্গী জাতীয় নেতা শহীদ এ এইচ এম কামারুজ্জামান হেনার কারাগারে হত্যার সংবাদ যেন এক অপ্রকাশযোগ্য বেদনা । এবার ভুতের গলি থেকে ফিরে এলেন প্রিয় স্বামীর স্মৃতিবিজড়িত ভূমি রাজশাহীতে। যে বাড়ি মানুষে গমগম করত, এসে দেখলেন সে বাড়ি ফাঁকাড়কেউ আর আসেন না।
পথেঘাটে চেনা মানুষও অচেনার মতো হেঁটে যায়। দেখেশুনে কষ্ট পেলেও হতাশ হলেন না জাহানারা জামান। শক্ত হাতে সংসারের হাল ধরলেন।
জাহানারা জামান ছিলেন ছয় সন্তানের জননী। দুই ছেলে এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন ও এ এইচ এম এহ্সানুজ্জামান।
চার মেয়ের ফেরদৌস মমতাজ, রওশন আক্তার, দিলারা জামান ও কবিতা জামান।
কবিতা জামান তৎকালীন সময়ে আমেরিকায় বসবাস করার কারণে তিনি আসতে পারেননি। তাই মাকে শেষ দেখা দেখতেও পারেননি তিনি।
একইভাবে পঁচাত্তরে দুই ছেলে বাবাকে শেষবারের মতো দেখতে পাননি। তার দুই বছর আগে তাঁদের ভারতের নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনে পড়াশোনার জন্য পাঠানো হয়েছিল। তখন খায়রুজ্জামান সপ্তম শ্রেণিতে আর এহ্সানুজ্জামান ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়তেন। বয়সে তাঁরা দেড় বছরের ছোট-বড়। মা-বাবার চাওয়া ছিল ছোট থেকেই তাঁরা মন্ত্রীর ছেলে নয়, সাধারণ মানুষের মতো বেড়ে উঠুক।
মিশনের আর পাঁচটা সাধারণ ঘরের ছেলের মতো তাঁদের দুই ভাইকে সব কাজ করতে হয়েছে। কষ্ট করে থাকতে হয়েছে।
৩ নভেম্বর বাবাকে জেলখানার ভেতরে হত্যা করা হয়েছে, সেদিন এ খবর দুই ভাইয়ের কেউ জানতেন না। পরের দিন মিশনের স্বামীজি দুই ভাইকে গাড়িতে করে তাঁর অফিসে নিয়ে যান।
সেখানে দুই ভাইয়ের সামনে চারটি দৈনিক পত্রিকা রেখে তিনি বাইরে চলে গেলেন। তাঁরা দুই ভাই দেখলেন চারটি পত্রিকাতেই জেলহত্যার ঘটনাকে প্রধান শিরোনাম করা হয়েছে।
আনন্দবাজার-এর শিরোনাম ছিল ‘ওদেরকে কাঁদতে দিন’। দুই ভাই শুধুই কাঁদলেন। কারও সঙ্গে কথা বলতে পারলেন না। এ সময় মায়ের সঙ্গে দেখা করার জন্য তাঁরা ব্যাকুল ছিলেন। কিন্তু অনিশ্চয়তার কারণে মা চাননি ছেলেরা দেশে ফিরে আসুক। মা তাঁদের চিঠি লিখলেন, তাঁদের বড় হতে হবে, মানুষ হতে হবে। বাবার মতো যোগ্য হতে হবে। এ জন্য নিজের সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। এ ঘটনার দুই বছর পর মা জাহানারা জামান দুই ছেলের সঙ্গে দেখা করতে ভারতে যান।
স্বামী মারা যাওয়ার পর জাহানারা জামান চার মেয়েকে নিয়ে রাজশাহীর কাদিরগঞ্জের বাসায় এসে যখন উঠলেন, তখন সে বাসা আর বাসযোগ্য ছিল না। এমনিতেই বাড়িটা পুরোনো ছিল। তার ওপর অনেক দিন ধরে পড়ে ছিল। ইউনুস আলী নামের একজন ঠিকাদারের সঙ্গে তাঁদের পরিবারের সখ্য ছিল। তিনি এসে মিস্ত্রি লাগিয়ে বাসাটা একটু ঠিকঠাক করে দিলেন। দোতলার যে ঘরে কামারুজ্জামান থাকতেন, সেই ঘরটি রাখা হলো।
কিন্তু সমস্যা হতে লাগল বর্ষার সময়। টানা দুতিন দিন বৃষ্টি লেগে থাকত। তখন পুরোনো বাড়ির টাইলস চুইয়ে পানি পড়ত। এ অবস্থায় ঝড় উঠলে মনে হতো ছাদ ভেঙে পড়বে। কত দিন যে জাহানারা জামান চার মেয়েকে সঙ্গে করে নিচের ঘরে বসে রাত কাটিয়েছেন তার হিসাব নেই।
সে সময় সংসারে আয় বলতে বাসার সামনে ২২০ টাকা ভাড়ার দুটি দোকান ছিল। আর অ্যাডকো নামের একটি ওষুধ কারখানার এমডি ছিলেন কামারুজ্জামান। কিন্তু কখনো ওই প্রতিষ্ঠান থেকে কোনো সম্মানী নেননি। সেই দুঃসময়ে ওই প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতি মাসে তাঁর পরিবারকে ৫০০ টাকা দেওয়া হতো। সে টাকা আবার গিয়ে নিয়ে আসতে হতো। চার বছর পর এহ্সানুজ্জামানকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। তারও এক বছর পরে আসেন খায়রুজ্জামান।
প্রতি মাসে অ্যাডকোতে গিয়ে ৫০০ টাকা নিয়ে আসার দায়িত্ব পড়ে খায়রুজ্জামানের ওপরে। অন্যদিকে দাদাবাড়ি ও নানাবাড়ি থেকে আসা চাল-ডালের সহযোগিতা নিয়েই তাঁদের চলতে হতো।
তাঁদের বাবা পাকিস্তান আমলে যখন সাংসদ ছিলেন তখন সম্মানী পেতেন ৫০০ টাকা। তাঁদের মায়ের হাতে ওই ৫০০ টাকা দিয়ে বলতেন এই দিয়েই সংসার চালাও। আবার দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে যখন মন্ত্রী হয়েছিলেন, তখন সম্মানী পেতেন দুই হাজার টাকা। ওই দুই হাজার টাকাই হাতে দিয়ে বলতেন এই দিয়ে সংসার চালাও। এ নিয়ে তাঁরা তাঁদের মাকে কোনো দিন আপত্তি করতে শোনেননি। আবার ঢাকায় তাদের বাসাতে যে মানের আসবাব, তাও একজন মন্ত্রীর বাসার সঙ্গে যায় না। এসব নিয়ে সন্তানেরা কেউ কোনো দিন মাকে হীনম্মন্যতায় ভুগতে দেখেননি।
ছেলে খায়রুজ্জামান রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র হয়ে রাজশাহীর যে উন্নয়ন করেছেন, তা নিয়ে মা জাহানারা জামান খুবই গর্বিত ছিলেন। পরবর্তীতে তার নাতনী ডাঃ আনিকা ফারিহা জামান অর্ণা ও রাজনীতির সাথে যুক্ত হয়ে পড়ে এবং রাজশাহী তথা উত্তরবঙ্গ ছাত্রলীগের এক বলিষ্ট নারী নেত্রীতে পরিনত হন।
সংগ্রামী নারী জাহানারা জামানের মৃত্যুর পর তার নাতনী ডাঃ অর্ণা জামান দাদা দাদী হারানোর বেদনাকে সঙ্গী করে এবং পূর্বপুরুষের গৌরব উজ্জ্বল ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে গুটি গুটি পায় বর্তমানে তিনি এখন বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ এর বন ও পরিবেশ বিষয়ক উপকমিটির সদস্য এবং রাজশাহী জেলা আওয়ামীলীগ এর সদস্য রূপে দেশ ও জাতির জন্য কাজ করে যাচ্ছেন।
উল্লেখ্য, ১৯৩৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর বগুড়া জেলার দুপচাচিয়া থানার চামরুল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন জাহানারা জামান। ২০১৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি সংগ্রামী ও মহিয়সী নারী জাহানারা জামান ইন্তেকাল করেন। জাহানারা জামানের মৃত্যু কালে বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর।
Development by: webnewsdesign.com