বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাজধানী ঘোষণা করা হয়েছিল মেহেরপুরের মুজিবনগরকে। বর্তমানে রাজধানীর মান তো নয়ই, নিরাপত্তার প্রশ্নে মফস্বল শহরের চেয়েও পিছিয়ে রয়েছে এই ঐতিহাসিক জেলা।
মেহেরপুরে যেতে চাইলে সড়ক পথই একমাত্র ভরসা। নেই নৌপথ-বিমানবন্দর, এখনো রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। অন্য কোনো জেলা থেকে দু’টি পথ দিয়ে মেহেরপুর শহরে প্রবেশ করা যায়— ঝিনাইদহ-চুয়াডাঙ্গা এবং ঈশ্বরদী ও কুষ্টিয়া হয়ে। শহরের প্রবেশপথ আমঝুপি ও খলিশাখুন্ডি থেকে মূল শহরের দূরত্ব প্রায় ২০ কিলোমিটার। শীত মৌসুমে সন্ধ্যা নামলেই পথ দু’টি হয়ে ওঠে ভয়ংকর। ডাকাতির আশঙ্কা ঘিরে ধরে গাড়ির চালক, যাত্রীদের।
তবে ডাকাতির মতো অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে জেলা পুলিশ নিয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা। তিন সিগন্যালে নিয়ন্ত্রণ করা হয় হাইওয়ে ট্রাফিক। খলিশাখুন্ডিতে কাজলা নদীর ঘাটে রাত ১২টায় ব্যারিকেড দেয় পুলিশ। রাত ১টা, রাত ৩টা ও ভোর ৫টায় পুলিশ প্রহরায় যাত্রীদের মেহেরপুর শহরে পৌঁছে দেওয়া হয়। সিগন্যাল পাওয়ার আগে যাত্রীবাহী বাসগুলো কুষ্টিয়া সীমানায় অপেক্ষা করে।
সরোজমিনে দেখা যায়, বাস থামার পরেই চৌকিতে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা যাত্রীদের সতর্ক করে দেন— ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা, বাস থেকে বেশি দূরে যাবেন না।
শ্যামলী পরিবহনের একটি বাসের চালক রাজু আহমেদ জানান, খলিশাখুন্ডি ঘাটে যদি রাতে পৌঁছে যাই, তাহলে অপেক্ষা করি। ভোর হলে তারপরই রওনা দিই। পথটা অনেক খারাপ। শুধু তো ডাকাতি নয়, প্রাণ হারানোর ভয় আছে। সম্প্রতি টহল পুলিশের পিকআপ ভ্যানের পেছনে আমরা যাই। রাত থেকে ভোর পর্যন্ত পুলিশের তিনটি টহল গাড়ি যায়। তখন পেছন পেছন সব কোচ যায়।
খলিশাখুন্ডি ঘাটে পুলিশের সিগন্যালে অপেক্ষমাণ জে আর পরিবহনের চালক সোহাগ বলেন, মেহেরপুর থেকে রাত সাড়ে ১০টায় সব শেষ বাস ছাড়ে। লাস্ট ট্রিপ পেলে আমাদের চেষ্টা থাকে যত দ্রুত কুষ্টিয়া পৌঁছানো যায়। কয়েক বছর আগেও ঢাকা থেকে কুষ্টিয়া পৌঁছাতে রাত ১২টা বেজে গেলে আমরা ভোর হওয়ার অপেক্ষা করতাম।
নাম গোপন রাখার শর্তে পুলিশের এক উপপরিদর্শক (এসআই) জানান, শীত মৌসুমে কুয়াশা ডাকাতদের সহায়তা করে। একটু দূরে যেতে পারলে আর খুঁজে পাওয়া কঠিন। যে কারণে আমরা যান চলাচল সীমিত করেছি। ৫টা বা ১০টা গাড়ি জমলে তারপর আমরা প্রটোকল দিয়ে নিয়ে যাই। বেশি রাতে শুধু কোচ চলে। আন্তঃজেলা বাস চলে না।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির দফতর সম্পাদক সামদানী বলেন, ওই এলাকায় ডাকাতির সমস্যা সব সময়ই ছিল। এটা নতুন কিছু না।
শ্যামলী পরিবহনের ব্যবস্থাপক জীবন চক্রবর্তী বলেন, ঢাকা থেকে কুষ্টিয়া হয়ে মেহেরপুরে আমাদের মোট ১৫টি গাড়ি চলছে। শ্যামলী পরিবহনের টিকিটে ড্রাইভার, হেলপার ও সুপারভাইজারের মোবাইল নম্বর উল্লেখ করা দেওয়া হয়। আমাদের সফটওয়ারে সেই ব্যবস্থা করা আছে। আমাদের অভিজ্ঞতা হলো— বাসের কর্মীরা নিয়ম ভেঙে পথ থেকে যাত্রী না তুললে এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে না। ডাকাতের সহযোগীরা যাত্রীবেশে উঠে জানিয়ে দেয় কখন বাস শহরের উদ্দেশে রওনা হচ্ছে।
‘টিকিট দেওয়ার সময় আমরা যাত্রীদের মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করি। যাত্রীবেশে কেউ ডাকাতি করার চেষ্টা করলে বা ডাকাতিতে সহায়তা করলে তাকে শনাক্ত করার সুযোগ আছে। আমরা মোবাইল নম্বরের তালিকা পুলিশকে সরবরাহ করলেই অপরাধী ধরা পড়ে যাবে। এছাড়া পুলিশ তাদের দায়িত্ব পালন করছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বভাবিক রাখা তাদের দায়িত্ব,’— বলেন জীবন চক্রবর্তী।
মেহেরপুর জেলা মোটর শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক মতিয়ার রহমান বলেন, আমাদের সংগঠনে প্রায় ৩ হাজার চারশ শ্রমিক রয়েছে। আন্তঃজেলা পরিবহন ও দূরপাল্লার কোচগুলোতে প্রতিদিন প্রায় ৫০ হাজার লোক মেহেরপুরে যাতায়াত করে। অনেক সময় ডাকাতের হামলা পরিবহন শ্রমিকরা আহত হন, মারা যান। কিন্তু আমরা শ্রমিকদের জীবন বীমার আওতায় আনতে পারিনি। তবে ডাকাতের হামলা বা সড়ক দুর্ঘটনায় কেউ মারা গেলে ফেডারেশনের পক্ষ থেকে বাসের চালকের পরিবারকে ৪০ হাজার, কন্ডাকটরের পরিবারকে ৩০ হাজার ও চালকের সহকারীর পরিবারকে ২০ হাজার টাকা আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়।
জানতে চাইলে মেহেরপুর জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) এস এম মুরাদ আলী বলেন, দু’টি পথ ব্যবহার করে মেহেরপুর শহরে প্রবেশ করা যায়। কুষ্টিয়া থেকে খলিশাখুন্ডি হয়ে এবং ঝিনাইদহ থেকে আমঝুপি হয়ে। এই দুই পথেই এক সময় অনেক ডাকাতির ঘটনা ঘটত। জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির বৈঠকে বিষয়টি বারবার আসছিল। পরিবহন মালিকরা আমাদের অনুরোধ করেন— পুলিশ পাহারায় যেন যানবাহন পার করে দেওয়া হয়। তাই শীতকালে, বিশেষ করে ঘন কুয়াশার সময় পুলিশ প্রটোকল দিয়ে গাড়ি পার করে দেওয়া হচ্ছে।
এক প্রশ্নের জবাবে এসপি বলেন, পুলিশের কাজই নিরাপত্তা দেওয়া। যতদিন প্রয়োজন হবে, ততদিন আমরা নিরাপত্তা দেবো। এরপর অপরাধ কমে গেলে পুলিশ স্ট্যান্ডবাই থাকবে।-তথ্য সূত্র : সারাবাংলা
Development by: webnewsdesign.com