দেশের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়ানো লাখ লাখ রোহিঙ্গাদের সংখ্যা নিয়ে যে সময় ‘নতুন তথ্য’ দিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন, ঠিক সেই সময় ভারতে রোহিঙ্গা পাচারে ‘ট্রানজিট রুট’ হিসেবে সিলেট সীমান্তকে ব্যবহার করছে মানবপাচারকারী চক্র। সিলেটের বিভিন্ন সীমান্ত ব্যবহার করে ভারতে যাওয়ার উদ্দেশে কক্সবাজার থেকে এ অঞ্চলে একের পর এক পালিয়ে আসছেন রোহিঙ্গা শরণার্থীরা। মাত্র ৩ দিনের ব্যবধানে এমন ২৩ জন রোহিঙ্গা আটক হয়েছেন সিলেট অঞ্চলে।
সর্বশেষ আজ (রোববার- ১৮ ডিসেম্বর) একই দিনে সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজারে ১৭ জন রোহিঙ্গা আটক হন। এর মধ্যে মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার গোয়ালবাড়ী ইউনিয়নের লাঠিটিলা এলাকার নালাপুঞ্জি থেকে একজন ও শ্রীমঙ্গল পৌরশহরের চৌমুহনা থেকে একসঙ্গে ১৬ জন রোহিঙ্গাকে আটক করা হয়েছে।
এর ৩ দিন আগে (১৪ ডিসেম্বর) জুড়ীর একই এলাকা থেকে স্থানীয় জনতা ৭ রোহিঙ্গাকে আটক করে পুলিশ ও বিজিবি’র কাছে সোপর্দ করেন।
রোহিঙ্গারা অবৈধভাবে ভারত যাওয়ার উদ্দেশে সিলেটের বিভিন্ন সীমান্ত ব্যবহার করে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। অভিযোগ রয়েছে- রোহিঙ্গাদের ভারত পাচারের ক্ষেত্রে সহযোগিতা করছে মানবপাচারকারী স্থানীয় চক্রগুলো। এছাড়াও অভিযোগ রয়েছে- নারী রোহিঙ্গাদের পাচার করে বিভিন্ন অনৈতিক কাজে বাধ্য করা হচ্ছে।
জানা গেছে, রোববার শ্রীমঙ্গলে ১৬জন রোহিঙ্গাকে আটক করেছে পুলিশ। সকালে চট্টগ্রাম থেকে মৌলভীবাজারে আসা এনা পরিবহনের একটি বাস থেকে তাদের আটক করা হয়।
শ্রীমঙ্গল থানাপুলিশ জানায়, রোববার সকাল ৭টায় মৌলভীবাজার জেলায় কর্মরত পুলিশ পরিদর্শক ক্যশৈনু ছুটি ভোগ শেষে চট্টগ্রাম থেকে এনা পরিবহনে (ঢাকা মেট্রো ১৫-৬৭০৩) যোগে মৌলভীবাজার আসার পথে সেই গাড়িতে থাকা কিছু যাত্রীদের তার রোহিঙ্গা হিসাবে সন্দেহ হয়। তিনি তাৎক্ষণিক বিষয়টি মৌলভীবাজার পুলিশ কন্ট্রোল রুমে জানান এবং মৌলভীবাজার পুলিশ কন্ট্রোল রুম বিষয়টি শ্রীমঙ্গল থানার ডিউটি অফিসারকে অবহিত করেন।
শ্রীমঙ্গল থানার এসআই মো. জাকির হোসেন রোববার সকাল সাড়ে ৭টার সময় পুলিশের টিম নিয়ে শ্রীমঙ্গল চৌমুহনায় অবস্থান নেন। তারা চট্টগ্রাম থেকে আসা বাসটি থামিয়ে গাড়িতে থাকা নারী-পুরুষ ও শিশুসহ মোট ১৬ জন যাত্রীকে রোহিঙ্গা হিসেবে শনাক্ত করেন। পরবর্তীতে এসআই জাকির হোসেন সব রোহিঙ্গাকে থানাহেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। জিজ্ঞাসাবাদকালে তারা কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে পালিয়ে এসেছে বলে স্বীকারোক্তি দেন।
শ্রীমঙ্গল থানার অফিসার ইনচার্জ জাহাঙ্গীর সরদার জানান, আটককৃত রোহিঙ্গারা অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে গমনের উদ্দেশ্যে কক্সবাজার রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে মৌলভীবাজার এসেছিলেন বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে। রোহিঙ্গাদের জিজ্ঞাসাবাদ শেষে পরবর্তী আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এদিকে, একই দিন অর্থাৎ- রোববার ভোর ৬টায় মৌলভীবাজার জেলার জুড়ী উপজেলার গোয়ালবাড়ী ইউনিয়নের লাঠিটিলায় বিজিবি’র দ্বায়িত্বপূর্ণ এলাকা নালাপুঞ্জি থেকে এক রোহিঙ্গাকে আটক করা হয়েছে। ওই সময় স্থানীয় ইউপি সদস্য আবুল কালাম ও আব্দুর রাজ্জাক এলাকাবাসীর সহযোগিতায় তাকে আটক করে গোয়ালবাড়ী ইউনিয়ন অফিসে নিয়ে যান। খবর পেয়ে জুড়ী থানার পুলিশ ও লাঠিটিলা ক্যাম্পের বিজিবি সদস্যরা সেখানে গিয়ে তাকে আটক করে।
আটককৃত রোহিঙ্গা যুবকের নাম শরীফ হোসেন (২২)। তিনি কক্সবাজারের ১ নম্বর কুতুপালং ক্যাম্পের জাহিদ হোসেনের ছেলে। তিন ওই ক্যাম্প থেকে পালিয়েছিলেন।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে রোহিঙ্গা ওই যুবক জানান, তিনি তার মায়ের সাথে রাগ করে কুমিল্লা সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেন। ভারতে প্রবেশ করে আগরতলায় পৌঁছে সেখান থেকে দিল্লি যাওয়ার পথে চেকপোস্টে ধরা পড়েন। পরে তাকে ত্রিপুরা রাজ্যের তারেকপুর বিএসএফ ক্যাম্পে পাঠানো হয়। সেখান থেকে বিএসএফ তাকে নালাপুঞ্জি এলাকা দিয়ে বাংলাদেশে পুশ ব্যাক করে।
এর আগে ১৪ ডিসেম্বর জুড়ীর একই এলাকা থেকে ৮ রোহিঙ্গাকে আটক করা হয়। ওই ৮ জনকে স্থানীয় জনতা আটক করে বিজিবি ও পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে। আটককৃতরা ছিলেন- মো. ইসমাঈল (১৬), সায়েদ (১৮), নূর কামাল, তহসিন মোহাম্মদ, সিনুয়ারা (৩০), আমিরা (৪), তাহেরা বিবি (২০), শহিদা বিবি (১৯)।
এর আগে চলতি বছরের ২৫ আগস্ট ভারতে যাওয়ার সময় মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার উত্তর শাহবাজপুর ইউনিয়নের কুমারশাইল সীমান্ত এলাকা থেকে আটক হন ৭ জন রোহিঙ্গা। তারা দালালের মাধ্যমে ভারতে যাওয়ার জন্য কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং থ্যাংখালী (এফডিএমএন) ক্যাম্প থেকে পালিয়ে বড়লেখায় এসেছিলেন।
এর প্রায় ৩ মাস আগে (১১ জুন) একই উপজেলার কুমারশাইল সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে ভারত প্রবেশের চেষ্টাকালে পুলিশ এক তরুণীসহ ৫ রোহিঙ্গাকে আটক করে। তারা কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে পালিয়েছিল।
তারও আগে চলতি বছরের ১২ মে মৌলভীবাজার শহরে শ্রীমঙ্গল-মৌলভীবাজার সড়কের বাসস্ট্যান্ড থেকে নারী ও শিশুসহ ১৮ রোহিঙ্গাকে আটক করে পুলিশ। তবে তারা ভারতে যাওয়ার পথে নয়, উল্টো ভারত থেকে কুলাউড়া উপজেলার সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকতে গিয়ে আটক হন। তাদের গন্তব্য ছিলো কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্প।
এছাড়াও গত তিন বছরে বিভিন্ন সময় আটকের মাধ্যমে সিলেট অঞ্চলে শতাধিক রোহিঙ্গা ধরা পড়েছেন। পরবর্তীতে তাদের কক্সবাজারের ক্যাম্পগুলোতে পাঠানো হয়।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, সিলেট সীমান্ত ব্যবহার করে রোহিঙ্গাদের পার্শ্ববর্তী দেশে পালানো বা সে দেশ থেকে সিলেটে প্রবেশ করানোর এসব ঘটনায় স্থানীয় মানবপাচারকারী চক্রগুলো জড়িত। দালালরা টাকার বিনিময়ে রাতের আঁধারে বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর নজর এড়িয়ে বিভিন্ন উপায়ে ভারত পাচার করে রোহিঙ্গাদের। তবে এমন ঘটনা সিলেট বিভাগে অহরহ ঘটনা ঘটলেও এসব চক্রকে এখনো চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি।
যদিও পুলিশ বলছে- আটককৃত রোহিঙ্গাদের এবার জিজ্ঞাসাবাদ করে নেপথ্যের দালালদের আইনের আওতায় নিয়ে আসার চেষ্টা করা হচ্ছে। শীঘ্রই এদের গ্রেফতারে অভিযান চালানো হবে।
এ বিষয়ে সিলেট রেঞ্জের ডিআইজি মো. মফিজ উদ্দিন আহম্মেদ পিপিএম রোববার (১৮ ডিসেম্বর) বিকেলে সিলেটভিউ-কে বলেন- প্রথমত: সীমান্তের বিষয়টি বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) দেখে। তবে আটকের পর রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করে পুলিশ।
সিলেটে ঘন ঘন রোহিঙ্গারা ধরা পড়ছেন উল্লেখ করে ডিআইজি আরও বলেন- এদের সীমান্ত পারাপারের ক্ষেত্রে স্থানীয় দালাল চক্র জড়িত এটা সত্য। তবে এবার যেসব রোহিঙ্গা আটক হচ্ছেন তাদের দীর্ঘসময় জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এর ভিত্তিতে রোহিঙ্গাদের সহযোগিতাকারী মানবপাচারকারী বা দালাল চক্রের সদস্যদের চিহ্নিত করে তাদের দ্রুত গ্রেফতার করতে চেষ্টা চালাবে পুলিশ।
Development by: webnewsdesign.com