রাজধানী অভিজাতদের হাতেই দূষিত হচ্ছে গুলশান-বনানী লেক

সোমবার, ২০ মে ২০২৪ | ১১:৩৩ পূর্বাহ্ণ

রাজধানী অভিজাতদের হাতেই দূষিত হচ্ছে গুলশান-বনানী লেক
রাজধানী অভিজাতদের হাতেই দূষিত হচ্ছে গুলশান-বনানী লেক
apps

রাজধানীর অভিজাত এলাকার ফুসফুস। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) আওতাধীন এই লেকে আশপাশের বাসিন্দাদের ফেলা বর্জ্য-আবর্জনার পচা দুর্গন্ধে দূষিত হচ্ছে পুরো এলাকা। সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো বলছে, স্থানীয় বাসিন্দাদের দায়িত্বহীনতার কারণেই এমন অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু সংস্থাগুলোও তাদের দায় এড়াতে পারে না বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

ঢাকা ওয়াসা বলছে, এটি তাদের একক দায়িত্ব নয়। স্থানীয় অধিবাসী ও সিটি করপোরেশনেরও দায়-দায়িত্ব রয়েছে। পুরো ঢাকা শহরের মধ্যে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ স্যুয়ারেজ লাইন রয়েছে। যাদের নেই তারা নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় এসটিপি করে সিটি করপোরেশনের মাধ্যমে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করবে, এটাই নিয়ম। কিন্তু লেকপাড়ের বাড়ির মালিকরা সেটি করেননি। সিটি করপোরেশনও এটি বাস্তবায়নে অধিবাসীদের বাধ্য করেনি। এ কারণেই এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।

গুলশান-বনানী-বারিধারা লেক দূষণের কারণ অনুসন্ধানে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে একটি সমীক্ষা করা হয়েছে। সেই সমীক্ষা বলছে, বনানী অংশে ১১৬৬টি বাড়ির মধ্যে মাত্র ২৩টি বাড়ি

নিজস্ব ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট স্থাপন করে স্যুয়ারেজ ব্যবস্থাপনা করছে; ১২০টি বাড়ি আংশিকভাবে স্যুয়ারেজের বিধিবিধান অনুসরণ করছে। অবশিষ্ট ১০২৩টি বাড়ির মালিক নিয়মনীতির তোয়াক্কা করে সরাসরি লেকে স্যুয়ারেজ লাইন স্থাপন করেছে। একইভাবে বারিধারা অংশে ৫৫০টি বাড়ির মধ্যে মাত্র ৫টি বাড়ির মালিক সঠিক ব্যবস্থাপনায় বর্জ্য অপসারণ করছে। ২০৩টি আংশিকভাবে নিয়মনীতি মেনেছে। অবশিষ্ট ৩৪২টি বাড়ির অধিবাসী সরাসরি লেকে বর্জ্য ফেলে দূষণ করছেন। অন্যদিকে গুলশান পশ্চিমাংশে ৮১৮টি বাড়ির মধ্যে মাত্র ৮টি বাড়ি শর্ত পূরণ করেছে। ৭৪টি আংশিক শর্ত পূরণ করেছে এবং ৭৩৬টি বাড়ির স্যুয়ারেজ লাইন লেকে যুক্ত। গুলশান পূর্বাংশে ৮৬৪টি বাড়ির মধ্যে মাত্র ৩টি বাড়ি সঠিক ব্যবস্থাপনায় বর্জ্য নির্গমন করছে। ৭০টি বাড়ির মালিক আংশিকভাবে মানলেও দূষণের দায় এড়াতে পারেন না। আর ৭৯১টি বাড়ি থেকে সরাসরি লেক দূষণ হচ্ছে। নিকেতনে ৪৩২টি বাড়ির মধ্যে মাত্র ২টি বাড়ির মালিক সঠিকভাবে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করছে। ৫৭টি আংশিকভাবে সঠিকভাবে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করছে এবং ৩৭৩টি বাড়ির মালিক সরাসরি লেকে ফেলছে বর্জ্য।

সমীক্ষা বলছে, লেকপাড়ের ৩ হাজার ৪৩০টি বাড়ির মধ্যে শর্ত মেনে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করছে ৪১টি, যা শতকরা ১ দশমিক ০৭ শতাংশ। আংশিকভাবে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করছে ৫২৪টি বাড়ির মালিক, যা শতকরা ১৩ দশমিক ৬ শতাংশ। আর সরাসরি লেকে ফেলছে ৩ হাজার ২৬৫টি বাড়ির মালিক, যা শতকরা ৮৫ দশমিক ২৪ শতাংশ।

গত শনিবার গুলশান-বনানী-বারিধারা লেক এলাকায় সরেজমিনে দেখা গেছে বাসাবাড়ির পয়ঃবর্জ্য এবং ড্রেনেজের বর্জ্য সরাসরি লেকে পড়ছে। আস্ত একটি জাজিম পড়ে আছে লেকে। ওয়াসার ড্রেনেজ লাইন দিয়ে রান্নার বর্জ্য ভেসে ভেসে লেকের পানিতে পড়ছে।

গুলশান-বনানী ব্রিজের পাশে দেখা যায় তিন পরিচ্ছন্নতাকর্মী লেক পরিষ্কার করছেন। কথা বলে জানা যায়, তাদের নাম রহমান, মতিন ও হালিম। প্রসঙ্গক্রমে রহমান বলেন, প্রতিদিন সকাল সাড়ে ৮টা সাড়ে ৪টা পর্যন্ত পুরো লেক পরিষ্কার করতে হয়। একপাশ দিয়ে পরিষ্কার শুরু করে শেষ হওয়ার পর ঘুরে এসে দেখা যায় আবার ময়লার স্তূপ জমে গেছে। ড্রেনেজের ময়লা, পলিথিন, বাসাবাড়ির ব্যবহার্য্য জিনিসও পাওয়া যায়। বৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত এ দুর্গন্ধ থাকে। ভারী বৃষ্টি হলে লেকের পানিতে স্রোত থাকায় দুর্গন্ধও কম থাকে।

জানা গেছে, গুলশান-বনানী-বারিধারা লেক পরিচ্ছন্ন ও পরিচর্যার জন্য ১০০ জন কর্মী রয়েছেন। এর মধ্যে ২৫ জন পরিচ্ছন্নতাকর্মী প্রতিদিন ৮ ঘণ্টা করে লেক পরিষ্কার করেন। গুলশান সোসাইটি ও রাজউক যৌথভাবে এটি পরিচালনা করে।

লেক দূষণের বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম বলেন, গুলশান-বনানী-বারিধারায় যারা থাকেন, তারা কোটি কোটি টাকার সম্পদের মালিক। অথচ তাদের বাড়ির বাথরুমের লাইনটি লেকে দিয়ে রেখেছেন। আমার ব্যর্থতা এখানেই, যা অত্যন্ত দুঃখজনক।

রাজউকও এক্ষেত্রে অনেকটাই অসহায়। রাজউকের সদস্য উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ মেজর (অব) সামসুদ্দীন আহমদ চৌধুরী আমাদের সময়কে বলেন, এককভাবে কোনো প্রতিষ্ঠানকে দায়ী করা যাবে না। ওয়াসা, সিটি করপোরেশন ও রাজউক সমন্বিতভাবে উদ্যোগী হলে লেকের দূষণ কমবে। ওয়াসা স্যুয়ারেজ লাইন স্থাপন করতে পারেনি বলেই সরাসরি লেকে লাইন স্থাপন করেছেন বাসিন্দারা। তিনি বলেন, দায়ী যে-ই হোক, রাজউকের পক্ষ থেকে নোটিশ করা হচ্ছে। যারা লেকে স্যুয়ারেজ লাইন দিয়েছেন, তাদের শাস্তির আওতায় আনা হবে।

গুলশান সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আহসান হাবীব রানা আমাদের সময়কে বলেন,আমরা গুলশান সোসাইটি উদ্যোগ নিয়েছি। লেক পরিষ্কারের কাজ চলছে। আমরা দেখেছি লেক পরিষ্কার রাখতে গেলে বিভিন্ন স্যুয়ারেজ সংযোগ বন্ধ করতে হবে। বিষয়টি মেয়রকে জানানো হয়েছে। তিনি আমাদের ৪টি সোসাইটিকে নিয়ে একাধিকবার বসেছেন। এ মুহূর্তে কাজ চলছে কীভাবে স্যুয়ারেজ সংযোগ সমস্যা দূর করা যায়, তা নিয়ে।

স্টামফোর্ড বিশ^বিদ্যালয়ের বায়ুম-লীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমেদ কামরুজ্জামান আমাদের সময়কে বলেন, এই লেক দূষণের দায় ওয়াসা, রাজউক এড়াতে পারে না। মেয়র কলাগাছ থেরাপি দিয়েছেন। এতে কাজ হবে না। যতক্ষণ পর্যন্ত বাড়ির মালিকরা নিজ উদ্যোগে স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট না করবেন, ততদিন দূষণ হবেই। এক্ষেত্রে প্রয়োজনে একাধিক বাড়ির মালিক যৌথভাবে একটি এসটিপি করে ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট করতে পারেন।

গুলশান সোসাইটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার সারওয়াত সিরাজ শুক্লা আমাদের সময়কে বলেন, বাসাবাড়ির শৌচাগারের বর্জ্য সরাসরি জলাশয়ে ফেলা হচ্ছে, এটা নিন্দনীয় কাজ। এগুলো বন্ধে গুলশান সোসাইটি কঠোর পদক্ষেপ নেবে। তবে ওয়াসা, রাজউকের দায়বদ্ধতা রয়েছে। রাজউক প্ল্যান পাস করার সময় স্যুয়ারেজ প্ল্যান্ট রয়েছে কিনা সেটা দেখার কথা। স্যুয়ারেজ লাইন ছাড়া কীভাবে ভবনের প্লান পাস হয়Ñ প্রশ্ন রাখেন তিনি।

ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী তাকসিম এ খান দেশের বাইরে থাকায় এ বিষয়ে তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। তবে ওয়াসার এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না-করার শর্তে বলেন, মানুষের কাছ থেকে স্যুয়ারেজের বিল নেওয়া হচ্ছে কিন্তু স্যারেজ লাইন দিতে পারছি না। কেন হচ্ছে না। এটি একমাত্র এমডি সাহেব বলতে পারবেন। যেভাবে লেকের পানি দূষণ হচ্ছে, তার দায় ওয়াসা এড়াতে পারে না।

Development by: webnewsdesign.com