জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরাল প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে রাজশাহীর কাটাখালি পৌরসভার মেয়র ও পৌর আওয়ামী লীগের আহবায়ক আব্বাস আলীর একটি কথোপকথনের অডিও রেকর্ড নিয়ে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে প্রতিবেদন প্রকাশের পর থেকেই তোলপাড় শুরু।
পরে প্রতিবেদকের ইনবক্সে মেয়র আব্বাস আলীর ঘরোয়া বৈঠকের আরেকটি অডিও রেকর্ড আসে, যেখানে তিনি রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন সম্পর্কে নানান আপত্তিকর অশ্লীল কথাবার্তা বলেন।
এসব ঘটনার পর থেকেই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে মেয়র আব্বাসের শাস্তির দাবিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিবাদ ও নিন্দার ঝড় উঠে। এখন মেয়র আব্বাসের এমন ধৃষ্টতার প্রতিবাদ ও শাস্তির দাবিতে রাজপথে নেমেছে বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠন সমূহ।
অডিও রেকর্ড ফাঁসের পরপরই বেরিয়ে এসেছে মেয়র আব্বাসের নানান চাঞ্চল্যকর তথ্য। প্রশ্ন উঠেছে দলীয় মতাদর্শ ও অবৈধভাবে কোটি কোটি টাকার মালিক হওয়া নিয়ে।
আব্বাস আলীর রাজনৈতিক উত্থানঃ
কাটাখালি সাহাপুর এলাকার আওয়ামী লীগ কর্মী আবু বাক্কার হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন কারাদÐ প্রাপ্ত আসামিই হলেন বর্তমান কাটাখালি পৌরসভার মেয়র আব্বাস আলী। তাও আবার নৌকা প্রতীকের। ২০০৪ সালে মামলা থেকে বাঁচতে যুবলীগে যোগদান করে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে আসেন। তার আগে তিনি বিএনপির রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। যুবলীগে যোগদান করেই মহানগর সহ-সভাপতি পদ পেয়ে যান তিনি। ২০১০ সালে আওয়ামী লীগ নেতার উপর হামলার ঘটনায় বহিষ্কার হন।।
কিন্তু চালাক চতুর ও উচ্চাভিলাষী এই আব্বাস আলী তৎকালীন স্থানীয় সংসদ সদস্য মেরাজ উদ্দিন মোল্লাকে ‘বাবা-ছেলে’ হিসেবে সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন। স্থানীয় সংসদ সদস্যকে ব্যবহার কাটাখালি অঞ্চলে ভীতিকর সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। ২০১১ সালে কাটাখালি মেয়র নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে অংশ গ্রহণ করেন। তার কারণেই সেইবার মেয়র নির্বাচিত হয় জামায়াতের মাজেদুর রহমান।
২০১৪ সালে সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান বর্তমান সংসদ সদস্য আয়েন উদ্দিন এবং মেরাজ উদ্দিন মোল্লাহ হন বিদ্রোহী প্রার্থী সেই সময় আয়েন উদ্দিনের কাটাখালির এক জনসভায় আব্বাস উদ্দীন এর গুন্ডাবাহিনী ও তার ভাই পৌর যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক আরিফুর ইসলাম মানিক।
সংসদ সদস্য নির্বাচনে বিজয়ী হন আয়েন উদ্দিন। তার নির্বাচনী জনসভায় বোমা হামলাকারীই রহস্যজনকভাবে হয়ে উঠে সবচেয়ে বিশ্বস্ত। একজন সন্ত্রাসী থেকে ১ বছরের মধ্যে জনপ্রতিনিধি! রাজনৈতিক সফলতা শুরু হয় তখন থেকেই।
২০১৫ সালের ৩০ ডিসেম্বর পৌরসভা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান পৌর আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি কিন্তু আব্বাস বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেন এবং আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে প্রতিরোধ করার ঘোষণা দেন পরবর্তী সময়ে প্রার্থী পরিবর্তন করে আব্বাসকে নৌকার প্রার্থী করা হয় এবং কেন্দ্র দখল সহ ব্যাপক ভীতিকর সন্ত্রাসী রাজত্ব কায়েম করে কাটাখালি পৌরসভার মেয়র হন আব্বাস আলী।
অথচ একই বছরে ২৩ ফেব্রæয়ারী জামায়াতের ইসলামের হয়ে বোমাবাজ করতে গিয়ে যৌথ বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হয় আব্বাস আলী। তৎকালীন রাজশাহী বিজিবির অধিনায়ক লেফটেনেন্ট কর্নেল শাহজাহান সিরাজ সে সময় গণমাধ্যমকে বলেছেন, যৌথ বাহিনীর সদস্যরা ম্যাজিষ্ট্রেটের উপস্থিতিতে তাকে গ্রেপ্তার করেছে। আব্বাস আলী বর্তমানে জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। তিনি বেশ কিছুদিন ধরে এলাকায় বোমাবাজি ও নাশকতা সংগঠিত করে আসছিলেন।
কাটাখালির পৌর মেয়র হয়েই আওয়ামী লীগের দীর্ঘদিনের ত্যাগী নেতাকর্মীদের কোনঠাসা করে ফেলতে শুরু করে। স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরা তার কথামতো না চললেই তাদের নামে দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন মিথ্যা মামলা।
আব্বাসের পারিবারিক রাজনৈতিক আদর্শ:
তার আপন ছোট ভাই আরিফুর ইসলাম মানিক কাটাখালি পৌর যুবদলের সাংগঠনিক। সে এলাকায় একজন চিহ্নিত কুখ্যাত সন্ত্রাসী ও ২০১৩-১৪ সালে বিএনপি জামাতের জ্বালাও পোড়াও য়ে রাজশাহীতে নেতৃত্বদানকারী। ২০১৪ সালের ১৫ই নভেম্বর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শফিউল আলম লিলেন কে হত্যা করে আরিফুল ইসলাম মানিক। কিন্তু তাকে বাঁচানোর জন্য তার ভাই মেয়র আব্বাস সরকারের বিভিন্ন উচ্চপর্যায়ে তদবির করেন। রাবি শিক্ষক হত্যা মামলায় অস্থায়ী জামিন পেয়ে বাইরে আসে। কিছুদিন পর আবারও মানিককে বিদেশি অস্ত্রসহ আটক করা হয়। বর্তমানে মানিক রাবি শিক্ষক হত্যা মামলায় মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত হয়ে কারাগারে।
আব্বাসের সৎ তিন ভাই জাতীয় পার্টির রাজনীতির সাথে জড়িত। যদিও তারা তাদের ভাই মেয়র আব্বাসের ছত্রছায়ায় সবকিছু করে।
মেয়র আব্বাসের যত দুর্নীতি ও অপকর্ম :
শ্যামপুর বালু মহল থেকে গড়েন অর্থের পাহাড় কাটাখালি পৌরসভার দোকানি হতে ব্যাপক চাঁদাবাজি, পশুর হাটের ইজারা, বালু মহল দখল, এলাকাবাসীর জমি দখল, মাসকাটাদিঘি বহুমুখী স্কুলের সভাপতি হয়ে নিয়োগ ব্যনিজ্য, স্কুলের জমির জায়গায় দোকান ঘর করে বিক্রি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেন আব্বাস।
সম্প্রতি সরকারি কোন নিয়ম নীতিমালা তোয়াক্কা না করে জলাবদ্ধতা নিরসনে তৈরি খালের উপর তৈরি করেন দোকান ঘর। উপজেলা নির্বাহী অফিসার ভূমি কমিশনার সহ জেলা প্রশাসক থেকে নিষেধ করার পর ও দোকান ঘর তৈরি অব্যাহত রাখে এবং দোকান বরাদ্দ করে কোটি টাকা আয় করেন।
শুধু কাটাখালি পৌরসভায় তাঁর রাজত্ব কায়েম করেননি খড়খড়ী বাইপাস সড়কে বাজারটি নামমাত্র মুল্যে ইজারা নিয়ে (যদি ইজারা বিষয় নিয়ে বিভ্রান্তি আছে) সিসি ক্যামেরা লাগিয়ে প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ টাকা চাঁদা তোলে তাঁর সন্ত্রাসী বাহিনী। যদি ও এই জায়গাটি ইজারা দেওয়ার কোন এখতিয়ার নেই জেলা প্রশাসকের কারন প্রকৃত হাটটি বাইপাস সড়ক থেকে ৩০০ মিটার দক্ষিনে। খড়খড়ি হাট টি সপ্তাহে দুই দিন বসতো আর বাইপাসের বাজারটি প্রতিদিনই বসে। আগে প্রতিজন বিক্রেতা থেকে ১০ টাকা আদায় করা হলেও এখন ১০০ টাকা পর্যন্ত আদায় করা হয় অস্ত্রের মুখে। এই বাজারটি হতে প্রতিদিন ৫০-৬০ হাজার টাকা আদায় করা হয়।
হরিয়ান রেলস্টেশন এর জায়গা দখল করে তৈরি করেন পশুর হাট। বালুমহল নিয়ে রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল আলম বেন্টুর সাথে দ্ব›দ্ব শুরু হয় এবং স্থানীয় আওয়ামী লীগ যুবলীগ ছাত্রলীগ এর সাথে বালুমহল নিয়ে গোলাগুলিতে একজন নিহতও হয়।
নিজেকে সভা সেমিনারে নিজেকে মাদকবিরোধী বললেও বাস্তবতা সম্পূর্ণ বিপরীত। কাটাখালির সাহাপুর, শ্যামপুর, ডাশমারী মালেকের মোড়, টাঙন এলাকায় ফেনসিডিল ব্যবসায়ীদের আব্বাসকে নিয়মিত চাঁদা দিতে হয়।
টানা পাঁচবছর স্থানীয় সংসদ সদস্যের ছত্রছায়ায় ও তার বিশ্বস্ত হয়ে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের উপর বিভিন্ন সময়ে হামলা, মামলা ও হুমকি দিয়ে প্রকৃত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের কোনঠাসা করে ফেলা হয়। স্থানীয় যুবলীগ নেতা শরীয়তের নামেই চারটি মিথ্যা বিস্ফোরক মামলা দেয় আব্বাস আলী। এরকম আরো দলীয় নেতাকর্মী আছে যাদের হামলা মামলা হুমকি দিয়ে নির্যাতন করেছে।
২০২০ সালের ২৬ শে আগষ্ট পৌরসভা নির্বাচনে মেয়র আব্বাসের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয় স্থানীয় আওয়ামী লীগ যুবলীগ ছাত্রলীগ সহ সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা। কিন্তু আবারও তিনি দলীয় মনোনয়ন পান।
এক্ষেত্রে স্থানীয় সংসদ সদস্য বিভিন্ন জায়গায় তদবির করে নৌকার মনোনয়ন পাওয়ার ব্যবস্থা করেন বলে অভিযোগ স্থানীয় আওয়ামী লীগের। মনোনয়ন পেয়েই প্রতিপক্ষ প্রার্থীদের হুমকি, হামলা, মামলা দিয়ে এলাকা ছাড়া করে আব্বাস।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, গত মেয়র নির্বাচনে খরচের বড় অংশ এসেছে স্থানীয় মাদক ব্যবসায়ীদের কাছে থেকে। স্থানীয় বিএনপি র আস্থাভাজন ও নিজস্ব লোক হওয়ায় আব্বাসের পক্ষে তারা নির্বাচনে কাজ করে।
স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের অভিযোগ, স্থানীয় সংসদ সদস্যের ছত্রছায়ায় মেয়র আব্বাস একক আধিপত্য তৈরি করে। প্রকৃত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বাদ দিয়ে বিএনপি জামাতের লোকজনকে নিয়ে বলয় তৈরি করে।
পবা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু শামা বলেন; বিএনপি জামাত মতাদর্শের এমন ব্যক্তিকে অবিলম্বে বহিষ্কার করার দাবি জানাই।
স্থানীয় দলীয় নেতাকর্মীদের সাথে কথা বললে সবার অভিযোগ, আব্বাস আলী মানুষকে মানুষ মনে করেনা। অহংকার ও খারাপ আচরণের কারণে ক্ষুব্ধ সবাই। কিন্তু ভয়ে কেউ প্রকাশ্যে বলতে পারে না।
এদিকে মেয়র আব্বাসের অডিও রেকর্ড ফাঁসের নগরীর বিভিন্ন স্থানে তার শাস্তির দাবিতে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল করেছে বিভিন্ন সংগঠন। এসময় দল থেকে তাকে আজীবন বহিষ্কার, মেয়র পদ থেকে অব্যাহতিসহ আব্বাস আলীর কুশপুত্তলিকা পোড়ানো হয়।
Development by: webnewsdesign.com