মানবপাচার সিন্ডিকেটের নেতৃত্বে সিলেটের ‘ইউরো আশিক’ সক্রিয়!

সোমবার, ১৬ আগস্ট ২০২১ | ২:২৫ অপরাহ্ণ

মানবপাচার সিন্ডিকেটের নেতৃত্বে সিলেটের ‘ইউরো আশিক’ সক্রিয়!
apps

লিবিয়া ও ইউরোপে মানব পাচারের নেটওয়ার্ক সিলেটসহ দেশের ১৫ জেলায় বিস্তৃত। এতে ১৪ চক্রের তিন শতাধিক সদস্য সক্রিয় আছে। লিবিয়ায় সক্রিয় আছে বাংলাদেশি আরও চারটি চক্র। মোট ১৮টি চক্র মিলে লিবিয়া ও ইউরোপে মানব পাচার করছে। এর মধ্যে সিলেট, সুনামগঞ্জ অঞ্চলে ঢাকার ‘ইউরো’ আশিকের নেতৃত্বে মানবপাচারকারীরা সক্রিয়।

গত বছরের ২৮ মে লিবিয়ার মিজদাহ শহরে মানব পাচার চক্রের সদস্যরা জিম্মিদশায় রেখে নির্বিচার গুলি চালিয়ে ২৬ বাংলাদেশিকে হত্যা করেন। এ ঘটনায় ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন থানায় মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে হওয়া ২৫ মামলার তদন্তে এসব তথ্য উঠে এসেছে। এর মধ্যে সম্প্রতি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ২৪ মামলার অভিযোগপত্র দিয়েছে। এতে মানব পাচার চক্রের ২৮৮ জনকে আসামি করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে চক্রের ১৫৩ জনকে গ্রেফতার করেছে সিআইডি। র‍্যাব এ মামলাগুলোর ছায়া তদন্ত করে।

তদন্তে উঠে এসেছে, লিবিয়ায় মানব পাচারের সঙ্গে দেশের ১৫ জেলার ১৪ চক্রের তিন শতাধিক ব্যক্তি জড়িত। প্রতিটি চক্রে অন্তত ২৫ জন করে সদস্য সক্রিয় আছেন। মানব পাচার চক্রগুলো ঢাকা, সিলেট, সুনামগঞ্জ, মাদারীপুর, কিশোরগঞ্জ, গোপালগঞ্জ, শরীয়তপুর, নোয়াখালী, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ফরিদপুর, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, নড়াইল, বরগুনায় সক্রিয় রয়েছে।

সিআইডি ও র‌্যাব সূত্র জানায়, আশিকের নেতৃত্বে একটি চক্র সিলেট, সুনামগঞ্জ, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, নোয়াখালী ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মানব পাচারে সক্রিয় আছে।

র‍্যাব জানায়, আশিকের (২৫) বাড়ি কেরানীগঞ্জের পার গেন্ডারিয়ায়। তিনি এসএসসি পাস। ২০১৯ সালে কেরানীগঞ্জে অবস্থান করে মানব পাচারে যুক্ত হন। ২০ থেকে ২৫ জনের একটি মানব পাচার চক্র গড়ে তোলেন। আশিকের পাচারকারী চক্রে রয়েছেন মামি সিমা আক্তার, খালা হেলেনা বেগম ও পলি আক্তার। গত ১০ জুলাই রাতে পুলিশ আশিককে গ্রেফতার করে। দুবাইয়ে অবস্থান করে লিবিয়া ও ইউরোপে মানব পাচারকারী তিন চক্রের (গাজী, কাজী ও বাবুল) মূল হোতা রুবেল মিয়া হলেন আশিকের মামা। রুবেলের বাড়ি গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার বড় ভাটারায়।

গাজী, কাজী, বাবুল চক্রের সদস্যরা বাংলাদেশ থেকে চাকরিপ্রত্যাশীদের ইউরোপের ইতালিতে নেওয়ার জন্য সাত-আট লাখ টাকা করে নেন। পাচারের শিকার ব্যক্তিদের প্রথমে লিবিয়ায় নিয়ে যাওয়ার জন্য তিন থেকে চার লাখ টাকা নেওয়া হয়।

র‍্যাব জানায়, গত দুই বছরে মামা রুবেল ও ভাগনে আশিক চক্র ৮০ জনকে ইউরোপে পাঠানোর কথা বলে বাংলাদেশ থেকে দুবাই হয়ে লিবিয়ায় নিয়ে গেছে। তাঁদের মধ্যে ১১ জনের কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। মাদারীপুরের নিখোঁজ দুজনের পরিবারের অভিযোগের ভিত্তিতে র‌্যাব অনুসন্ধান চালিয়ে এই পাচারকারী চক্রের সন্ধান পায়। তাঁদের স্বজনদের কাছ থেকে ৮ লাখ করে ১৬ লাখ টাকা নেওয়া হয়। লিবিয়ার মিজদাহে হতাহত ব্যক্তিদের কয়েকজনকে আশিক চক্র সে দেশে পাচার করেছিল।

গত ১০ জুলাই রাতে আশিকসহ মানবপাচারে জড়িত ৭ জনকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। গ্রেফতার অন্যরা হলেন- আজিজুল হক (৩৫), মিজানুর রহমান মিজান (৪৩), নাজমুল হুমা (৩১), সিমা আক্তার (২৩), হেলেনা বেগম (৪২) ও পলি আক্তার (৪৩)। তাদেরকে মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ ও ঢাকার কেরানীগঞ্জ, যাত্রাবাড়ী থেকে গ্রেফতার করা হয়।

পরে ১১ জুলাই র‌্যাব জানায়, ঢাকার কেরানীগঞ্জের মো. আশিক লিবিয়ায় দুই বছর অবস্থানের সময় মানবপাচার সিন্ডিকেটে জড়ায় আশিক। ২০১৯ সালে দেশে ফিরে কেরানীগঞ্জে থেকে মানবপাচার ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নেয়। দুবাইয়ে থাকা মামা রুবেলের মাধ্যমে গড়ে তোলে ‘রুবেল সিন্ডিকেট’। রুবেলের মাধ্যমে অনলাইন ভিসা, বাংলাদেশি সংগ্রহ ও নৌপথে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে দুবাইয়ে মানবপাচার করত আশিক।

ইউরোপে ধারাবাহিক মানবপাচারের কারণে কেরানীগঞ্জের আশিকের নাম হয়ে যায় ইউরো আশিক।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে তথ্য যাচাই–বাছাই না করে সহজ উপায়ে লিবিয়া ও ইউরোপ যেতে গিয়ে মানুষ প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। তিনি বলেন, সারা দেশে মানব পাচারে সহস্রাধিক ব্যক্তি জড়িত।

মামলাগুলোর তদন্ত তদারক কর্মকর্তা সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইমের বিশেষ পুলিশ সুপার মুহাম্মদ সাইদুর রহমান বলেন, পাচার চক্রের সদস্যরা দেশের বিভিন্ন জেলায় ছোট ছোট গ্রুপে বিভক্ত হয়ে লিবিয়ায় মানব পাচার করছেন। লিবিয়ায় সক্রিয় কয়েকটি মানব পাচার চক্র ভূমধ্যসাগর দিয়ে ইউরোপে ঝুঁকিপূর্ণ মানব পাচার করছে।

তিনি বলেন, প্রতারণার শিকার হয়ে দেশে ফিরে যাঁরা টাকা ফেরত পান, তাঁরা মানব পাচারকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করতে আগ্রহী হন না। কিছু ব্যক্তি মামলা করলেও মানব পাচারকারীর পূর্ণাঙ্গ নাম-ঠিকানা দেন না।

Development by: webnewsdesign.com