বিরাট বেহেস্তের বাজার : জামিল জাহাঙ্গীর

শনিবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৫ | ১২:০৫ অপরাহ্ণ

বিরাট বেহেস্তের বাজার : জামিল জাহাঙ্গীর
apps

অভিরামপুর স্টেশন আসার আগেই অভির ঘুম ভেঙ্গে গেলো। বাসের তীব্র ঝাঁকুনিতেও চমৎকার ঘুমিয়ে নিতে পারে ও। রাস্তার বড় বড় গর্তে পড়ে চাকাগুলো যখন লাফ দিয়ে ওঠে তখন যাত্রীরাও শরীক হয় ওদের সাথে। এবারের প্রচ- ঝাঁকুনিটা ঘোড়াঘুমো অভিকেও তুলে দেয়। চোখ কচলাতে কচলাতে চোখে পড়লো শহরের ছড়িয়ে পড়ার দৃশ্য। রিয়েল এস্টেট কোম্পানীর চোখ ধাঁধানো বিজ্ঞাপন পেরিয়ে টুকরো টুকরো জমিন। দেয়ালবদ্ধ কৃষি জমিগুলোর হাতজোড় মিনতিও ওর চোখে পড়ছে। শহর হেঁটে হেঁটে গ্রামের দিকে আসছে নাকি গ্রাম দৌড়ে দৌড়ে শহরের দিকে যাচ্ছে বুঝা মুশকিল। ওর চিন্তাজগতে বাজপড়ার মতো বাসের হেলপার হাঁক দিলো অভিরামপুর! অভিরামপুর! জেলা পরিষদের প্রশস্ত রাস্তা পেরিয়ে ওকে এখন যেতে হবে ছয় কিলোমিটার। একসময় এই পথটুকুই ছিলো ছিনতাইকারী আর নেশাখোরদের দখলে। এখন দুরত্ব কোন বিষয়ই নয়। ডানে বামে বেশক’টি মোটরজান। জ্বালানী সহজলভ্য হওয়া কিংবা পকেটে টাকার অবাধ চলাচলে এখানে এখন মটরের ভটভট ঘটঘট শব্দ খুব স্বাভাবিক হয়ে গেছে। চেনাজানা কাউকে এসময় ডাকতে হয় না। ওদেরই ছুটে আসার কথা। বারকতক তাকিয়েও অভি কোন পরিচিতজনের দেখা পেল না এবার নিজ থেকে সিএনজিচালিত বাহনের সামনে এসে চালককে বলে,

-যাবেন কুমারহাট?
-ভাঁড়া ঠিক করি লন
-ঠিক করোনই লাগবো, ঠিক নাই কিল্লাই

-রাইতকা ভাঁড়া ডাবল
-হাইঞ্জা বেলায় রাইত ক্যামনে কি!
-বিশ টেঁয়া কম নিয়াম, গেলে উডেন
ঢাকা থেকে দুইশ দশ কিলোমিটার আসতে তিনশো টাকা। আর এই সামান্য ছয় কিলো রাস্তার জন্য ভাড়া একশো আশি। অভি কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। চালকের কথার ধরণ শুনেও ওর আত্মসম্মানে লাগছে। এখানে কি জনপ্রতিনিধি নেই নাকি? সামান্য ভাড়া ঠিক করতে হলেও হাজারটা ক্যাচাল। নিরবে ভাবছে ও। চালক আগ্রহ হারিয়ে চলে গেছে অন্যদিকে। ওকে তেমন গ্রাহ্যই করছে না। অভি একটা রিক্সার কাছে গিয়ে দেখলো, চালক আয়েশ করে সিগারেট টানছে। সিগারেটের আগুনে পুড়ছে লস এনজলেসের সিনেমাপল্লী হলিউড।

মুখ থেকে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে
– ভাইয়ে কোনাই যাইবেন?
– আঁই তো জাহান্নামো যাইতাম চাই নিতেন হাইরবেন নি?
– ভাঁড়া দিলে আরো দূরো লই যাইয়াম, আন্নে খালি বই থাইক্কেন
– কন কতো লাইগবো।
– আগে আন্নের জাহান্নামের নাম কন
– কুমারহাট হুজুরবাড়ি।
– তোবা আস্তাকফিরোল্লা হিয়ানো বেহেস্তের টিকিট হাওন যায়।
– আন্নে লইছেন নি
– মশকরা করিয়েন না এতো হইসা কি আঁর আছে নি।
– হইসা দিলেই বুঝি টিকিট দি দেয়।
– হইসা ন রে ভাই হইসা ন ডলার, রিয়েল, হাউন্ড …
– অ্যাঁরতন ডলার নাই, ক টেয়া দিলে হাইয়াম
– ভাইর কি আইজই লাগবো না হরে অইলেও অইবো
– নগদ হাইলে বাঁইর কতা কে কয়
– আন্নে হাইলেও হাইতেন হারেন।

– তো চলেন
– ভাড়া ঠিক করন লাগতো ন।
– আন্নে হুজুরের বাইত যাইবেন ভাঁড়া কিল্লাই লইতাম
– আঁই তো আল্লার আস্তে যাইতামন্ন
– তোইলে আন্নে মুঠের বিতরে করি হাদিয়া দিয়েন
অভি এখানকার ছেলে। ভাষা এখনো পুরোপুরি রপ্ত। বাংলাদেশের অন্য অঞ্চলগুলোর তুলনায় এখানকার ভাষা সহজবোধ্য। হাস্যরস মিশ্রিত থাকার কারণে যে কেউ এতে মজা পায় এবং দ্রুত আত্মস্থ করার চেষ্টা করে। যার অন্য এক আঞ্চলিকতা আছে তার পক্ষে একইসাথে দুটো আঞ্চলিক ভাষা রপ্ত করা সম্ভব হয় না। কারো কারো ক্ষেত্রে এ নিয়ম খাটে না। তারা ব্যতিক্রম। অভি চালকের হুজুরপ্রীতি দেখে বিস্মিত হয়। রাত সাড়ে ন’টা শহরের মানুষের কাছে খুব কিছু না হলেও গ্রামের হিসেবে প্রায় গভীর। এমনটাই ছিলো ওর ধারণা। কিন্তু পাশ দিয়ে যে হারে মটর সাইকেল, প্রাইভেট কার, সিএনজি, স্কুটার ছুটে যাচ্ছে তা বেশ অবাক হবার মতো। চালকের সাথে ক্লোজ হবার জন্য প্রথমে ওর নাম জিজ্ঞেস করতে হয়। অভিকে ওর জ্যাঠা শিখিয়েছেন।

– ডাইবার সাবের নাম কি?
– মা কয় খা বাপে কয় লেক
– আব্দুল খালেক।
– আঁই তো বেগ্গাইন কই ন
– বুইজ্জি, আঁই বুঝি লইছি। হত্তেদিনই কি রাস্তা এরুম গরম থায়?
– ভাইয়ে জে কি কন, আইজ তো কোন ভাঁড়াএ নাই, মাইসে হিমড়ায় লাইন লাইন ধরি আঁডি আঁডি আইয়ে
– বেহেস্তের টিকেটের লাই কেন?
– বেকেরএ মরন লাগবো এই দুইন্না আর কদিনের
– দুফুরে কি খাইছেন
– হুরির ভকতা আর মুশুরির ডাইল।

– বাত খান ন?
– বাত ছাড়া কি আঙ্গুল চাবাইছিনি!
– আঁই মনো কইচ্ছি আন্নের হুজুরে বেকের লাই পলাউ রাঁধি হাডায়, আন্নে হিয়ান খাইছেন।
– আন্নে গেলে খাবাইবো আঁই তো আর মারু হাপ্পান হিঁন্দি যাই ন।
– আন্নে চাইলে আঁরতন ওউকগা বেশি আছে দিতাম হারিয়াম।
– আন্নের লগে কতা কওনেত্তাইন রিক্সা চালান বালা।
– আইচ্চা চালান
খালেক মুখে কুলুপ এঁটে রিক্সা চালাচ্ছে। প্রথম প্রথম স্পিড ব্রেকার আসলে ব্রেক চেপে ধরে সাবধানে পার হতো এখন ধপ করে আছাড় খাওয়াচ্ছে। দু‘পাশের বাড়িগুলো চেনা যাচ্ছে না। সুপারি পাতার ঐতিহ্যবাহী বেড়ার বদলে ইটের দেয়াল। রঙবেরঙের বাতি জ্বলছে। জানালা খোলা পেয়ে নেচে নেচে এগিয়ে আসছে। মালাইকা। ক্যাটরিনা। লেডী গাগা। রিয়ান্না। শাকিরা। কোথাও কোথাও ডিশ। কোথাও কোথাও ডিভিডি। পাশ দিয়ে হুস করে চলে যাচ্ছে পাজেরো, টয়োটা, পালসার, গোনা যাচ্ছে না। কোন কোন বাড়ির আলোকসজ্জা এতো তীব্র যে কারোরই চোখ ঝলসে যাবার মতো। দুই কিলোমিটার পার হতেই মাইকের শব্দ কানে আসছে। জিকির হচ্ছে। পরম দয়ালুর নাম এতো বিচ্ছিরিভাবে এতো লোক একসাথে উচ্চারণ করছে। আসলেই তিনি রাহমানুর রাহীম। নইলে এসব সহ্য করেন কি করে। অভি এ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে এসেছে। বেহেস্তী হুজুরের
জলসা নিয়ে একটি অর্টিকেল ছাপা হবে ওদের পত্রিকায়। সম্পাদক সাহেব ওকে পাঠিয়েছেন কারণ পুরো অফিসে কেবল ওই বেহেস্তী অঞ্চলের। সম্পাদকের মুখের উপর ও বলে দিতে পারতো, আজ প্রচার মাধ্যমে যাকে বেহেস্তী হুজুর বলে ফলাও করছে। দুই তিনটা চ্যানেল লাইভ অনুষ্ঠান করে সারা বিশ্বের মানুষকে পানি পড়া বিতরণ করছে। এই লোকই একসময় চানাচুর বিক্রী করতো। মাদ্রাসার পড়া মুখস্ত করতে পারতো না খায়ের আম্মদ। একসময় ক্লাশের খাতা থেকে তার নাম কাটা যায়। তিনমাইল দূরের লজিং বাড়িতে এই সংবাদটা চেপে যায়। জানাজানি হবার পর সেখানে নতুন হুজুর আসে। খায়ের আম্মদ আর যাবে কোথায়? লজিং বাড়িকে অভিদের এলাকায় জায়গীর বলে। জায়গীরের মুন্সী থাকতো ঘাঁডায়। রাইত কাচারির ভিতরে চানাচুর চাবাতো। আর চিন্তা করতো। সেই মিথ্যুক মুন্সী খায়ের আম্মদ দশ বছর আগে জাগীরবাড়ির তিনজোড়া শিলপাটাসহ নিজেও নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। দশ বছর পর ফিরে এসে বলে,
-আঁর গুরু স্বপ্নে আঁরে কইছে তিনজোড়া হাঁডাহুতা লই আয়, তোরে বেহেস্তী ওষুধ বানান শিখাই দিয়াম। এতো রাইত আঁই হাঁডাহুতা কোনাই হাইয়াম? মাইনষেরে ঘুমের তন উডান ঠিক না। হেয়াল্লাই আঁই কাছে ধারে যা হাইছি দৌড় দি ছুডি গেছি ওস্তাদের ধারে। ওস্তাদ আঁরে কয়,

-বেত্তরমিজ এইগাইন কইত্তোন আইনচ্ছোত। বেগ্গানির মইধ্যে মোসল্লা লাগি রইছে। আঁই জুত করি খাড়াই রইলাম। ওস্তাদ কয়, হাঁচ বছর হচ্ছুমমিদ দিগিন আঁডি যাবি। একবারও হিচে চাইতি হাইত্তি ন। হেয়ার হর আবার হাঁচ বছর হুবমিদ্দিগিন আঁডি আই যদি আঁরে হাঁচ হেসুম তোরে আই টোটকা দিয়াম। অভি টোটকা রিপোট লিখতে চায়। কিন্তু সম্পাদক ছাপাতে পারে না। এখনকার সম্পাদক সাহেব আবার ঈমানদার টাইপের মুনাজাত বিষয়ে প্রত্যেক সংখ্যায় কিছু না কিছু লেখা ছাপা হবেই। বেহেস্তী হুজুর আইজ মুনাজাত দিবেন। অভি তারই ছবি ও সংবাদ সংগ্রহ করতে এসেছে। মুনাজাতের ময়দান থেকে অভিদের বাসা দুই কিলোমিটার দূরে। রিক্সা এখন আলোকসজ্জার আওতায় চলে এসেছে। দুই পাশে সারি সারি টিউবলাইট। আলোরদ-ের চারপাশে পোকামাকড় ভিড় জমাচ্ছে। মানুষের ভিড় ও ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে। রাস্তার ঠিক নিচে জমিনের আইলে আইলে দোকানের সারি। প্রত্যেক দোকানেই উপচেপড়া ভিড়। অন্যসময় হলে চেনাজানা মানুষ দেখা যেত। এতো ভিড়ের মধ্যে চেনাজানা মানুষ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। ভিড় বেশি হয়ে গেলে পাশের মানুষটির অবয়বও দেখার সুযোগ হয় না। টোটকা জীবন ভিড়ের মধ্যে চ্যাপ্টা হয়ে যায়। যখন সোঁজা বাকা বোধ ঠিক থাকে না। প্রত্যেকটা পৃথক অবয়ব তখন নিজের শেপমতোন এগুতে চায় একগুঁয়েরকমে। তখন আচরণটা মুখ্য থাকে না। আকার আয়তনটাই বিবেচ্য হয়ে ওঠে। অভির মনে পড়ছে না চানাচুর মুন্সীর হুজুর হবার আগের অবয়বটা। তবে চাচাতো ফুফাতো ভাইদের কল্যাণে যা যা বর্ণনা পাওয়া গেছে তার ভেতর একটা প্লাস্টিকের মডেল ঢোকালেও একটা ছবি পাওয়া যায়। ছাগলাদাঁড়ি আর কপালের বাম দিকে একটা বড় তিলকসহ স্যান্ডেগেঞ্জি পরা লুঙ্গিয়াল লোকটাই এখন বেহেস্তর টিকিট দিচ্ছে। অভি যখনই তার উচ্চতার কথা ভাবছে এখনই পাশ দিয়ে কেটে গেলো পতাকাবাহী গাড়ি। কুলুপ আঁটা খালেক কোকাকোলার বোতল খোলার মতো আওয়াজে বলে উঠলো
– আইজকার কোয়াল ভালা মন্ত্রী সাব আইচে
– মন্ত্রীর লগে কোয়ালের কি
– হাদিয়া হাদিয়া
– কে কারে দেয়Ñ হাদিয়া?
– বাই এ বুঝি এম্মি নতুন আইছেন, বাড়ি কি হেনি না চিটারাং অভির টনক নড়ে। চালক তাকে বাইরের মনে করেছে। ভাষার পারফেকশন কি করে এমন এলোমেলো হয়ে গেছে! আত্মস্থ হয়ে জিজ্ঞেস করে
– হেনি চিটারাং ও কি এম্মি চলি আইচেনি?
– বাইর গরু গাঁডার ঘাঁস খায় না, হেমিক্কা মানুষই বেশিÑ
– আর কইত্তোন আইয়েÑ
– বিলাত, ডুবাই, কইলকাত্তা, বোম্বাই, করাচী, জিদ্দা,

বেকমিত্তোনই আইয়ে
– ও আইচ্ছা
রিক্সা থেকে নামার পর অভি মাটি আর আকাশ কিছুই দেখছে না। মানুষ আর মানুষ। গুনে শেষ করা যাবে না। পল্টনের ময়দানে লোক সমাগম করতে পয়সা ঢালতে হয়। এখানে মানুষ এসে স্বেচ্ছায় পয়সা খরচ করে যাচ্ছে। জুতা জমা রাখলে পাঁচ টাকা, বাই সাইকেল দশ টাকা, মটর সাইকেল পঞ্চাশ টাকা, প্রাইভেট কার একশো টাকা, বাস তিনশো টাকা, ট্রাক ফ্রি। জমা রাখার যায়গাও হবে প্রায় একশো একর। ফসলী জমির বারোটা বাজিয়ে এটা এখন একটা অদ্ভুত আলোকনগরী। জেনারেটর পল্লী দেখে তো মাথা বিগড়াবার মতো অবস্থা শতাধিক পোর্টেবল জেনারেটর একসঙ্গে শব্দ করে চলছে। জ্বালানী সংরক্ষিত আছে পর্যাপ্ত। প্যান্ডেলের এক মাথা থেকে অন্য মাথা একসঙ্গে দেখা যায় না। অভি বারকতক চেষ্টা করতে করতে ক্লিক বাটনে চাপ দেয়া শুরু করে। হাজার হাজার মানুষ বসে আছে সামনের খালি মঞ্চের দিকে তাকিয়ে। অভি শুনেছে সাধারণত দু এক মিনিটের বেশী সময় হুজুর মানুষের সামনে থাকেন না। এখানে যারা আসে রাতারাতি তাদের ভাগ্য খুলে যায়। এমপি, মন্ত্রী, সচীব, জর্জ, ব্যরিস্টার, নায়ক, নায়িকা, ভিলেন, অধ্যাপক, ডাক্তার সবাই ভক্তি করে মুক্তির পথ খুঁজে পান। দিনাজপুর থেকে হুজুরবাড়ি এসেছেন। আফরাদ আহমেদ। পেশায় কলেজ শিক্ষক। তিন তিনবার বিয়ে করেছেন প্রত্যেকবার স্ত্রীরা চলে গেছে। তার মা পাঠিয়েছেন এককুড়ি মাগুর মাছ নিয়ে। লোকটা মাটির হাড়ি হাতে মাথায় করে ঘুরে চলছে তিনদিন। এরমধ্যে সাতটা মাছ মরেই গেছে। মাইকে বারবার দুরুদ পড়ার তাগিদ দেয়া হচ্ছে। মিনমিনে ভিক্ষের কণ্ঠে কেউ একজন মাইক্রোফোনে বেসুরো কণ্ঠে

পড়ছে।
আশেকানে জিকির করে
গাছের হাতা বুরবুরায়
দ্বীনের কথা মনে অইলে
শয়তানেতো কুরকুরায়।
চারিদিকে শয়তান হননের তোড়জোড় শুরু হয়ে যায়। শান্ত মানুষগুলো মুহূর্তেই অশান্ত হয়ে দৃশ্যমান ও অনিবার্যকে অস্বীকার করে অদৃশ্য কারো কাছে নত হবার অভিনয় করে। এইসব কুশীলব এতোটাই নিস্প্রাণ যতোটা না হলে জীবন থাকে না। ওদের স্বপ্ন, ওদের বিশ্বাস, ওদের নি:শ্বাসের সাথে সংযুক্ত নয়। অভি ঠিক করেছে ও ওর কাজ করে যাবে। এ্যাসাইনমেন্টএর যায়গায় এ্যাসাইনমেন্ট থাকুক। ভালো করে তথ্য নিতে পারলে কিছু নতুন কিছু বের হয়ে আসতে পারে। হাতিয়ার নুরুদ্দিন জিকির করা ছাড়া কোন কথা বলতেই নারাজ। ওর কথা হলো আল্লার কাছে যাওনের লাই তরীকা হাইছি। আন্নে বডর বডর করেন কিল্লাই?
আন্নে সাম্বাদিক অইলেও আঁই কিছু কইতামন্ন।
অভি দেখতে পাচ্ছে আশেপাশের গ্রামের চেনাজানা মানুষের দু‘চারজন এখানে বেশ জমিয়ে বসেছে। ওর সাথে একটু ব্যাক্য বিনিময় হবারও ফুরসৎ নেই কারো। স্থানীয় বড়দলের নেতারা চ্যালা চামুন্ডা নিয়ে চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। চমৎকার সহাবস্থান! পত্র পত্রিকায় এদের মারামারির সংবাদ প্রকাশ পায়। অভি বুঝতে পারছে না এতাটা কী করে সম্ভব! তারা বেপারী আর চৌধুরীদের বিবাদতো তিন পুরুষের এখানে তারা দুজনই যেন মায়ের পেটের ভাই। মঞ্চের ঠিক সামনের দিকে সোফার বসা জলপ্রতিমন্ত্রী। তাঁর আসে পাশে সরকারী-বেসরকারী কর্মকর্তা, নেতা, সমর্থক। স্থানীয় পুলিশের বড়কর্তা খুবই তৎপরতা দেখাচ্ছেন। মন্ত্রীসাহেব এলে তিনিই নিজেই সারারাত তদারকি করেন পুরো এলাকার। স্থানীয় এমপি বয়সে মন্ত্রীর সিনিয়র হওয়ায় তোয়াজ-পিয়াজ বাদ দিয়ে আরেক পাশে ঘনঘন পায়চারি করছেন। তার পালিতরা এখন মন্ত্রীর বন্দনায় বেষ্টনী করে দাড়িয়ে আছে। মনু মুন্সীকে চিনতে অভির ভুল হবার নয়। মনু মুন্সী এখারকার খাদেম। অভি আগেই জেনে এসেছে। এবার মনু মুন্সী মাইক্রোফোন হাতে ঘোষণা দিলেন।

-সাম্বাদিক বাইয়েরা, আন্নেরা ছবি তুইল্লে জিকিরি বান্দাগো ধ্যান ভাঙ্গি যায়। আন্নেগল্লাই ছবি আমরা তুলি রাইখছি। আমনেরা আর কষ্ট না করি আঙ্গো দপ্তরখানাত এট্টু হাঁড়াই যাইয়েন। হুজুরে আন্নেগো খাচদিল করি দোয়া কইরবেন। অভি সাংবাদিক একথা কাউকে বলে নি। ক্লিক ক্লিক করে ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুললেও ওর ক্যামেরায়ও কোন লেখা বা নাম্বার নেই। তবুও দপ্তরের দিকে পা বাড়ালো। এরকম দরবারের রিপোটে সাংবাদিকরা কি করতে পারে এসব নিয়ে ভাবার সময় নেই মোটেও। মানুষের ভিড় এড়িয়ে দপ্তরের দিকে এগুনো আর ধর্মপুস্তকে বর্ণিত পুলসিরাত পার হওয়া বোধ হয় একই রকম ঝঞ্জাটের। দপ্তরে ঢুকতেই বিশালদেহী এক দারোয়ান। দারোয়ান না বলে বলা যায় দ্যা ওয়ান।
গুরুগম্ভীর গলায় প্রশ্ন করলো
-পত্রিকার নাম কী?
– চিচিংফাঁক
– সাপ্তাহিক না মাসিক
– দৈনিক
– হত্তেকদিন বার অয়?
– অয়
– কইতাইন?
– ঢাকা
– ইয়ানো কিল্লাই?

– এ্যাসাইনম্যান্ট
অভি বেশ লজ্জিত হলো। তবুও যদ্দেশ যদাচার। পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে দিলো।
– পত্রিকার নাম তো
– বাংলাঠিক
– আগে কি কইছেন?
– এইডাই
– কার্ড কই
– কী কার্ড
– আন্নে কি নতুন সাম্বাদিক অইছেন নি, ডান্ডি কাডর্, ডান্ডি অভি কার্ড দেখালো। লোকটার উসখুস ভাব দেখে অভি ভেতর ভেতর মজা পাচ্ছে। আর একটা লোক বেশ বয়স্ক। খুব সুন্দর পাঞ্জাবী পরা। পাঞ্জাবীর পুরো শরীরে জরি আর পুতির মনোহর কাজ। অতিরিক্ত আতরের ঘ্রাণ বেলফুলের বিকৃত সুগন্ধি ছড়াচ্ছে।

-হুজুরে যা কওনের বেককতা কাগজো লেই দিছে। আর অন্নেগো বেকেরল্লাই নজরানা দিছে। কোনার মধ্যে হাবুল হাটিয়ালের বইর মধ্যে সই করি আন্নেরে লই জাইবেন। আর পত্রিকাত হুজুরের দাবাত ছাপাইবেন। আল্লার কাম করনের এরুপ সুযুগ আর হাইতেন ন। আঁই আন্নেগোত্তন মাফ চাই- হুজুরের শরীরডা ভালা না। আঁর হেম্মি যাওন লাইগবো, বাংলাঠিক পত্রিকার সাম্বাদিক বাই আন্নে আঁর লগে আইয়েন। হুজুরে আন্নের লগে কতা কইবো। চারদিক থেকে শোরগোল ওঠে

-আমরা কী দোষ কইরচ্ছি, আমরা কি দোষ কইচ্ছি মুরুব্বীমতন লোকটা ঘুরে দাঁড়ায়ে সবার উদ্দেশ্যে বাইএ ঢাকাত্তন আইছে। হুজুরের বন্ধু বড় সাম্মাদিক উনারে হাডাইছেন। উনি তো দূরের মেজজান, আর আমরাতো বেকে এ বাইর মানুষ। সাংবাদিকরা সই করছে আর একটা করে খাম পকেটে পুরছে।

প্রকাশ্যে এমন হাদিয়া নামের খাম অভি আর কোনদিন দেখেনি। অভি বৃদ্ধ লোকটার পেছন পেছন এগিয়ে যাচ্ছে। যাওয়ার পথ যেনো শেষ হতে চায় না। এদিকটায় মহিলাদের উপচে পড়া ভিড়। যেতে যেতে বৃদ্ধই কথা শুরু করে।
– সম্বাদিক সাবের দেশ কোনাই
– বাংলাদেশ।
– আঁই অঞ্চলের কথা কইচি।
– সব অঞ্চল
– আন্নে কি আঁর লগে মশকারি করেননি
– আমি তো সব জায়গাতেই যাই।
– ইস্থায়ী ঠিকানা কোন জাগাত।
– জানি না
– বাপ মা জরমোস্থান
– এখানে কাছেই
– গ্রামের নাম কি।
– পুরানপুর
– হুরানহুর! কোনবাড়ি
– মাস্টার বাড়ি
– আন্নে কার হুত
– আব্বা আম্মার। কাকে চেনেন আপনি
– হাবেজ হারুন, মাওলানা মক্কান, হাজী সাব, রেজাকার আবুল।
– আপনার আত্মীয় কে এদের মধ্যে।
– আঁর ভাই মনু মুন্সী বিয়া কইচ্ছে হেই বাইত।
– আপনি এখানে
– এক নম্বর খাদেম
– খাদেমের আবার নাম্বার হয় কি করে?
– আঁই অইছি হুজুরের খাস লোক।

– বাকী লোক বুঝি ঘাস লোক
– না না, আন্নে এডা কিয়া কন! হুজুরের ঘর আই গেছে। আইয়েন আন্নেরে হরিচয় করাই দেই।
পরিচয় করার কিছু নেই। হুজুর নিজে এসেই করমর্দন করলেন। কোলাকুলি করতে গিয়ে অভির মনে হলো হুজুরের তাকদ তারিফযোগ্য। বেশ শক্তি রাখেন দেহখাঁচায়। সবই আল্লার খেলা, বুইজ্জেননি নাইলে বেনে আন্নে আছিলেন ঢাকাত আর আঁই দরিয়ার ধারো হেই আমরাই রাইত একজন আরোকজনের বুকোত। চারপাশ থেকে বেশ কয়েকজন শব্দ করে বলে ওঠে আলহাম্দুলিল্লাহ আলহামদুলিল্লাহ। হুজুর হাতের ইশারা করে অন্যদের বাইরে যেতে বলে। আল্লা মাইনষেরে কইছে। হে মাইনষেরা তোমরা কাম করি খাও। আঁই তোমাগো এমনে এমনে কিছু দিতান ন। তোমরা আঁত হাতিও, আই তোমগরে খালি আতে হিরাইতাম ন। অভি চুপ করে থাকে, বেহেস্তী হুজুর আবার তাকে উদ্দেশ্যে করে বলে আন্নের লাই কী সেবা কইত্তাম কন এবারও অভির কিছুই বলার থাকে না। পরিকল্পিত প্রশ্নগুলো পাঁক খেয়ে পড়ে যাচ্ছে মাটিতে। হুজুর চোখ বন্ধ করার ভঙ্গিতে আবার বলা শুরু করে হাশরের মাডো আল্লাহ আঁরে জিঙ্গাইবো তোর ঘরো আঁই মেজজান হাডাইছি তুই হেয়ারে সমাদর করোছ ন। আঁই কি জবাব দিয়াম।

অভি বুঝতে পারছে না কি বলা কিংবা কি করা উচিৎ। হুজুরকে বেহেস্ত সম্পর্কে প্রশ্ন করার পরিকল্পনা ছিলো। এখন মনে হচ্ছে না প্রশ্নগুলো প্রয়োজনীয়। ভাইজান মনে অয় কতা একটু কম কন। এডা ভালা, এডা ভালা। কম কতা কইলে গুনা কম অয়। গুনা কম অইলে ছোয়াব বেশি অয়। কম কতার মানুষ তাড়াতাড়ি বেহেস্তে চলি যাইবো। অভির মেজাজ বিগড়ে যেতে চায়। কিন্তু নিজেকে ঠা-া রাখা কষ্টকর হলেও ভেতর ভেতর আপোষ তৈরী হয়ে যায়। চুপচাপ শুনতে থাকে। বলা কওয়ার ধার ধারে নেই। খাদেমদের কাছে পাওয়া লিখিত বক্তব্য পড়েই অভি বুঝতে পেরেছে এখানো বেহেস্ত নয় ¯্রফে একটা ধোকাবাজির ব্যাবসা চলছে। রাজনীতি ও প্রশাসন একযোগে এটা চালিয়ে যাচ্ছে। এর বিরুদ্ধে কথা বলতে গেলে ঠোঁট ও জিভের ইন্সুরেন্স করে আসতে হবে। হুজুরের বলা কথায় না ঢুকে অভি একটু অন্যরকম চেষ্টা নিলো হুজুরের ধ্যানরত অবস্থায় নিজেই প্রশ্ন করলো আলমাস আমিন আপনার বন্ধু? আলমাস আমিনডা আবার কে? বাংলাঠিক পত্রিকার সম্পাদক ও আমিন্নার কতা নি কইছেন?
– হু
– ঠিক বন্ধু না মুরীদের মতোন বন্ধু আর কি।
– বুঝলাম না
– আন্নের তো এবো বুঝনের বয়স অয় ন।
– কি করে বুঝলেন
– অইলে কী আর আন্নে আমিন্নার পত্রিকাত কাম কইত্তেন।
– আমার তো পত্রিকা নেই
– তাইলে এক্কান বানাই হালান।

– বানাতে তো অনেক টাকা লাগে
– আন্নে চাইলে আল্লার ধারো কি কম আছেনি।
– পত্রিকা থাক আমরা বেহেস্তের কথা বলি।
– দুইন্নার মইধ্যে বেহেস্ত লই টানাটানি কইত্তে নাই।
– কেন আপনি তো সবাইকে দিচ্ছেন।
– মাইনষে যদি হায় আন্নের সমইস্যা কি?
– আমারওতো দরকার
– লাইগলে নেন
– দেন।
বলে অভি হাত বাড়ায়। বেহেস্তী হুজুর তার কোমর থেকে কাপড়ের ব্যাগ বের করে। একটা প্যাকেট নিয়ে বলে এটা আমিন্নারে দিয়েন। কইয়েন বালা করি যেন রিপোর্ট ছাপাই দেয়। আর এডা অইছে আন্নের লাই। কষ্ট করি আইছেন। সময় দিতাম হারি ন। তয় কথা এক্কান আন্নেরে অ্যাঁই কইয়াম। মাইনষের কাম করন বালা কিন্তু নিজের কামই অইছে আসল কাম। জেবো হইসা না থাকলে এওন আর কেও কারোরে দাম দেয় না। আন্নে হইসা চিনেন। হইসা এ আন্নেরে বেহেস্ত চিনাই দিবো। বেহেস্তী হুজুর চলে যাবার পর অভি তার জন্য বরাদ্দ খামটা খুললো। এখানে এক হাজার টাকার কড়কড়ে দশটা নোট। স্যারের জন্যে বান্ডিল আছে দুটো। খারাপ না মাসে দুইবার আসতে হবে। যতদিন আসা যায় ততোই বেহেস্ত।

Development by: webnewsdesign.com