বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশনের (বিআরটিসি) চট্টগ্রাম ডিপো অনিয়ম, লুটপাট আর দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
অভিযোগ আছে, পাঁচ মাস আগে ঢাকার যাত্রাবাড়ী ডিপো থেকে চট্টগ্রামে বদলি হয়ে আসার পর আত্মীয়সহ ৬-৭জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে নিয়ে সিন্ডিকেট করে অনিয়ম-দুর্নীতির সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন ম্যানেজার মাসুদ তালুকদার।
এর আগে মাসুদের বিরুদ্ধে ঢাকার যাত্রীবাড়ি ডিপোয় দায়িত্ব পালনকালে বড় ধরনের অনিয়মের অভিযোগে বিভাগীয় মামলা হয়। ওই মামলায় তাকে শাস্তিও দেওয়া হয়। বিষয়টি মাসুদ তালুকদার স্বীকারও করেছেন।
দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত এমন কর্মকর্তাকে চট্টগ্রাম ডিপোয় বদলি করায় ক্ষুব্ধ এখানকার কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। তাদের অভিযোগ, চট্টগ্রাম ডিপোয় এসেও অনিয়ম-দুর্নীতির সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন মাসুদ তালুকদার। আত্মীয়-স্বজন নিয়োগ দিয়ে সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন। গত সপ্তাহে সরকারি সংস্থা অডিট এন্ড একাউন্টস’র চার সদস্যের একটি টিম বিআরটিসি চট্টগ্রাম ডিপোয় চারদিন অবস্থান করে ম্যানেজার মাসুদের নানা অনিয়ম-দুর্নীতির সন্ধানও পেয়েছে।
সংস্থাটির দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা জানান, তদন্তে ম্যানেজার মাসুদের বিরুদ্ধে পেট্রোল পাম্প থেকে কমিশন বাণিজ্য, বাসের ট্রিপ চুরি, চুঙ্গি আদায়, খাতায় রাজস্ব আয় কম দেখিয়ে টাকা আত্মসাৎ, নগরের কদমতলী বিআরটিসি টার্মিনালে সরকারি জায়গা ভাড়া দেয়া, স্থায়ী চালক থাকা সত্ত্বেও ক্যাজুয়াল লোক দিয়ে গাড়ি চালানো, বাস মেরামতের নামে টাকা লুটপাট, অতিরিক্ত জনবল দেখিয়ে বিপুল অংকের টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া গেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ট্রিপ চুরি, রাজস্ব লুট, রক্ষণাবেক্ষণের নামে অতিরিক্ত ব্যয় দেখানো, ঋণ করে কেনা বাস সিন্ডিকেটের সহযোগিতায় অচল করে রাখায় চট্টগ্রাম ডিপোর লোকসানের পরিমাণ বাড়ছে। অথচ বিআরটিসির চালক ও অন্য কর্মচারীরা বলছেন, দুর্নীতি বন্ধ হলে সংস্থাটির আরও লাভ হওয়ার কথা।
ব্যয় বেশি হবে বলে রক্ষণাবেক্ষণ হচ্ছে না পুরনো ও অচল বাসগুলোর। শ্রমিকরা জানান, বাসের ট্রিপ চুরি, যন্ত্রাংশ কেনার নামে অতিরিক্ত ব্যয় ও নিজেদের পকেট ভারী করেছেন ডিপো ব্যবস্থাপক মাসুদ তালুকদার ও তার সিন্ডিকেটের লোকজন। ডিপোয় যানবাহন মেরামত ব্যয়, গাড়িতে অতিরিক্ত জ্বালানি তেল ব্যবহারসহ বিভিন্ন দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার অভিযোগও প্রবল।
জানা গেছে, বিআরটিসি চট্টগ্রাম ডিপোর অধীনে রুট আছে ১১টি। মোট ৯০টি বাসের মধ্যে সচল আছে ৫০টি। মোট স্থায়ী জনবল ৯৭ জন। ক্যাজুয়াল স্টাফ আছেন ৩২ জন। অভিযোগ আছে, ডিপো ব্যবস্থাপকের সিন্ডিকেটের জন্য গাড়িচালকদের আয় থেকে মাসে গড়ে লাখ টাকা চাঁদা বা চুঙ্গি তুলতে হয়। না হলে চালকদের অন্যত্র বদলি করে দেওয়াসহ বিভিন্ন হয়রানি করা হয়।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, রাজস্ব আত্মসাৎ, দরপত্র ছাড়াই বহিরাগতদের বাস ইজারা দেওয়া, বহিরাগত ও অবৈধভাবে নিযুক্ত কন্ডাক্টরদের দিয়ে ভাড়া আদায়, রেজিস্টারে আয়ের হিসাব না রাখায় লোকসান দেখানোর সুযোগ বাড়ছে এ ডিপোতে।
এদিকে দুদকের অভ্যন্তরীণ একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, চট্টগ্রাম ডিপোভিত্তিক টায়ার, টিউব, লুব্রিকেন্ট, তেল, গ্যাস, কম্প্রেসার কেনা, দৈনিকভিত্তিক চালক ও কন্ডাক্টর নিয়োগ, বাস মেরামত, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, ডিপোর জায়গা লিজ দেয়াসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে স্বেচ্ছাচারীতার আলামত মিলেছে।
পেট্রোল পাম্প থেকে ম্যানেজার মাসুদ তালুকদারের কমিশন বানিজ্যের বিষয়ে বিআরটিসি ফিলিং স্টেশনের কর্মকর্তা মোহাম্মদ ইলিয়াস জানান, ২০১০ সালে তাদের প্রতিষ্ঠানের ২ লাখ ৭৪ হাজার টাকা বাকেয়া রেখে বদলি হন। বকেয়া পরিশোধের জন্য বারবার তাগাদা দেয়ার পর তৎকালীন ডিপো ব্যবস্থাপক মোস্তাফিজুর রহমান বিআরটিসি ফিলিং স্টেশনের বকেয়া বাবদ ৫ লাখ ৩৩ হাজার ৪৪০ টাকার ডাচ-বাংলা ব্যাংকের একটি চেক দেন। কিন্তু সেটি ব্যাংক থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়।
তিনি বলেন, সম্প্রতি বকেয়া আদায়ের জন্য গেলে বর্তমান দায়িত্বপ্রাপ্ত বিআরটিসি, চট্টগ্রাম ডিপোর ম্যানেজার ইঞ্জিনিয়ার মাসুদ তালুকদার বকেয়া বাবদ বিআরটিসি ফিলিং স্টেশন বরাবরে ৫০ হাজার টাকার চেক দেন। সেটি ব্যাংকে পাশ হয়। এরপর বাদ বাকি টাকা পরিশোধের জন্য তাগাদা দিলে দেড় লাখ টাকার একটি চেক দেন।
ইলিয়াসের অভিযোগ, সেই চেক ব্যাংকে পাশ করিয়ে দেয়ার শর্তে ঘুষ হিসেবে তাদের প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা আদায় করেন ইঞ্জিনিয়ার মাসুদ তালুকদার। এখনও বিআরটিসি’র কাছে ওই প্রতিষ্ঠানের পাওনা আছে ৬ লাখ ৮০ হাজার টাকা।
জানা গেছে, চট্টগ্রাম নগরের কদমতলীতে বিআরটিসি টার্মিনালে বিপুল পরিমাণ অব্যবহৃত সরকারি জায়গা রয়েছে। এটির দায়িত্বপ্রাপ্ত মহিউদ্দিন রিপন। অভিযোগ আছে, ২০ বছর আগে চালক হিসেবে বিআরটিসিতে চাকরি পেলেও রিপন প্রায় ১৫ বছর ধরে আছ।
Development by: webnewsdesign.com