নিরাপদ যাত্রী সেবা নিশ্চিত করতে বঙ্গবন্ধু কন্যা যখন রেলপথে গুরুত্ব দিয়ে প্রতি বছর উন্নয়নের জন্য বরাদ্ধ দিচ্ছে তখনই যাত্রী ও পণ্য পরিবহনে রেলের যে অবদান রয়েছে, সেইভাবে দুর্নীতির হরিলুট চালিয়ে সরকারের সকল অর্জনকে ম্লান করছে খোদ রেলের একটি চক্র। রেলের জ্বালানি তেলের একটা বড় অংশ চোরায় পথে বিক্রি হয় খোলাবাজারে। এ জন্য সারাদেশে রয়েছে চোরাই সিন্ডিকেট। এসব সিন্ডিকেটকে প্রতক্ষ্য ও পরোক্ষ্যভাবে রেলের কতিপয় কর্মচারী থেকে শুরু করে উপরের চেয়ারের কর্মকর্তাদের সংশ্লিষ্টতা আছে। মালবাহী ট্রেনগুলো দীর্ঘ সময় বিভিন্ন স্টেশনে থামিয়ে রাখা হয়। অনেক সময় ডিপো থেকে ইঞ্জিনে তেল নেওয়ার সময়ও চুরি হয়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, গত কয়েক বছরে রেলের জালানি তেলের ব্যবহার বেড়েছে প্রায় ৩২ থেকে ৩৪ শতাংশ। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে ইঞ্জিনের যে চাহিদা তার চেয়ে তেলের অনেক বেশি খরচ দেখানো হয় অর্থাৎ কর্তৃপক্ষ যখন তেল বরাদ্দ দেয় তখন পরিমানটা বেশি দেখিয়ে বরাদ্দ দেয়, আর এই বাড়তি তেলই গন্তব্যের মাঝ পথে বিক্রি করে চোরাই চক্র।
রেলওয়ে সূত্র জানাগেছে, দেশে প্রতিদিন সাড়ে ৩ শত ট্রেন চলাচল করে পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলের রেলে।এসব ট্রেনে পৌনে দুই লাখ লিটার ডিজেল লাগে। এ হিসেবে, বছরে তেল খরচ হয় ৬ কোটি ৩৮ লাখ ৭৫ হাজার লিটার। যাত্রী ও মালবাহী বিভিন্ন ট্রেন থেকে প্রতিদিন তেল চুরি হয় ৪০ হাজার লিটার, বছরে গড়ে প্রায় দেড় কোটি লিটার। যার বাজার মূল্য ৯৪ কোটি ৯০ লাখ টাকা।
রেলের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলের ১৯০টি ট্রেনেই তেল চুরি হচ্ছে। ৫০টি চিহ্নিত স্থান থেকে ১৫০ এর বেশি সিন্ডিকেট এ তেল চুরিতে সক্রিয়। সবচেয়ে বেশি তেল চুরি হচ্ছে চট্টগ্রাম ও পাকশী রেল বিভাগে। রেলওয়ের সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন শাখার তথ্যানুসারে, তেল চুরি করা হয় চলন্ত ট্রেন থেকে ও ট্রেন থামিয়ে দুভাবেই। ট্রেনের ইঞ্জিন, পাওয়ার কার থেকে দিনে ২০ হাজার লিটার তেল চুরি হচ্ছে। লোকো শেড থেকে প্রতিদিন ১৫ হাজার লিটার, চলন্ত ট্রেন থেকে দিনে ৫ হাজার লিটার তেল চুরি হয়। এছাড়াও বছরে ইঞ্জিন ওয়েল চুরি হয় এক কোটি টাকার।
রেলওয়ে সূত্র বলছে, লোকো শেড থেকে নেওয়ার পর নির্দিষ্ট দূরত্বে ট্রেন চলাচল পর্যন্ত ট্রেনচালক হিসাব বুঝিয়ে দেন সংশ্লিষ্ট শাখাকে। কিন্তু এই হিসাবেই গরমিল থাকে। এর সঙ্গে সম্পৃক্ততা থাকে স্টেশন মাস্টার, অন ডিউটি লোকোমাস্টার, সহকারী লোকোমাস্টার, ফুয়েল চেকার, রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনি, ট্রেনের গার্ড ও রেল পুলিশের সদস্যরা। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ এখন রেল ইঞ্জিন ক্যালিব্রেশন পদ্ধতি চালু করলেও সেটি সীমাবদ্ধ রয়েছে কয়েকটি ট্রেনে তাই হরহামেশাই চলছে রাষ্ট্রীয় তেল চুরির এই মহোৎসব।
বাংলাদেশ রেলওয়ে রেলকে পূর্বাঞ্চল এবং পশ্চিমাঞ্চলে ভাগ করে কার্যক্রম পরিচালিত করছে। দেশের পূর্বাঞ্চলের ১৫-২০ টি স্পটে রেলের জালানি তেল চুরি করা হয়। চট্টগ্রামের মিরসরাই মস্তাননগর, সিজিপিঅয়াই, সিজিডি, নিউমরিং, চিনকি আস্তানা, শরশাদি, গুনোবতি, নরশিংদির রায়পুর, হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জ,সাটিয়াজুরি রেল স্টেশন, সুটাং রেল স্টেশন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কোড্ডা, দুবলা আউটার সিগন্যাল, আখাউরা স্টেশন পূর্বাঞ্চলের সব চেয়ে বড় তেল চুরির স্পট।
এদিকে পশ্চিমাঞ্চলের ২০ থেকে ২৫টি তেল চুরির স্পটের মধ্যে রয়েছে রাজবাড়ি জেলার কালুখালি স্টেশন, কুষ্টিয়ার পোড়াদহ, হালশা, যশোরের শিঙ্গিয়া রেল স্টেশন, দিনাজপুরের পার্বতীপুর জংশং, বেলায়চন্দি স্টেশন, সৈয়দপুর স্টেশন,যশোরে শিঙ্গিয়া রেল স্টেশন, দিনাজপুরের পার্বতীপুর জংশং, বেলায়চন্দি স্টেশন, সৈয়দপুর স্টেশন , এছাড়া লালমনিরহাটের হাতিবান্ধা স্টেশন, পাবনার চাটমোহর ও ঈশ্বরদী রেল স্টেশন, আব্দুলপুর, নন্দনগাছি স্টেশন,আমনুরা জংশন,রহনপুর স্টেশন, চাঁপাই নবাবগঞ্জ স্টেশন, রাজশাহী স্টেশন কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বিশাল তেল চোরাই চক্র।
চট্টগ্রামে রেলের জ্বালানি তেল চুরির অন্যতম স্পট মস্তাননগর। সূত্র বলছে, ডাউনে আসা ট্রেন থেকে প্রতিদিন গড়ে তিনশত থেকে পাঁচশত লিটার তেল চুরি হয় এই স্পটে। লোকোমাস্টার, সহকারী লোকোমাস্টার, ফুয়েল চেকার, ট্রেন কন্ট্রোলার, স্টেশন মাস্টারের যোগসাজশে এই চক্রটি চলে। অভিযোগ আছে, মস্তাননগরের তেল চুরির এই সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রনে রয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে রানিং স্টাফ ও শ্রমিক কর্মচারী সমিতির সাধারণ সম্পাদক লোকোমাস্টার জাহাঙ্গীর। চলতি বছরের ৫ অক্টোবর মিরসরাইয়ের মস্তাননগর (সোনাপাহাড়) এলাকায় রেলের তেল চুরির ঘটনার সাথে জড়িত ব্যক্তিদের থেকে মাসহারা নেওয়ার অভিযোগে জোরারগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মফিজ উদ্দিন ভূঁইযা কে প্রত্যাহার করে চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ।
এদিকে চট্রগ্রামের সিজিপিঅয়ায় ইয়ার্ডে ট্রেনের সান্টিং এর সময়ও প্রতিদিন গড়ে সাতশত লিটার তেল চুরি হয়ে থাকে। মূলত ট্রেনের ট্র্যাক পরিবর্তন করতে নির্ধারিত সময়ের চেয়ে অধিক সময় দেখিয়েই এই চুরি করে চোর চক্র। ইয়ার্ডের এই সিন্ডিকেটের নেতৃতে রয়েছে সান্টিং লোকোমাস্টার সেলিম, অদুদ, ফরিদ নামের রেলের তিন কর্মচারী। এখান থেকে প্রতিদিন নগরীর সল্টগোলায় সাজ্জাদের ভাই হোসেনের কাছে এই চোরাই তেল বিক্রি করা হয়। রাত তিন টায় আপে আসা ট্রেনগুলো থেকে ফারনেস ওয়েলও চুরি করা হয় সান্টিং লোকোমাস্টার সেলিমের নেতৃতে। চোরাই তেলের এই কার্যক্রমে পরিচালনা করতে ইয়ার্ড মাস্টার মালেককে মাসিক মাসহারা দিতে হয় বলে সূত্র বলছে।
এদিকে টি এক্স আর ও শেডে ডিজেল গাড়ি থেকে প্রতি মাসে ১০-১৫ টন তেল চুরি হয়ে থাকে। এই তেল চুরির মুল হোতা বাবলু। চট্টগ্রাম নগরীতে রেলের তেল চুরির এই স্পট গুলোর নাটের গুরু হলো ফুয়েল চেকার কাশেম ও লোকোশেড ইনচার্জ বেলাল হোসেন। তবে রেলের পূর্বাঞ্চলের প্রধান যন্ত্র প্রকৌশলী ফকির মো: মহিউদ্দিন যোগদানের পরে তেল চুরি ঠেকাতে তিনি সবোর্চ্চ চেষ্টা করছেন। দীর্ঘ দিনের চলমান এই চুরি চক্র বর্তমানে কিছুটা হ্রাস পেয়েছে।
এ বিষয়ে পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের প্রধান যন্ত্র প্রকৌশলী ফকির মোঃ মহিউদ্দিন বলেন, তেল চুরি প্রতিরোধে রেলের কতৃপক্ষ বিশেষ কঠোর ব্যাবস্থা নিয়েছে।
Development by: webnewsdesign.com