আজ সারা বিশ্বে পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক দুর্নীতি দমন দিবস। ২০০৩ সালের ৩১ অক্টোবর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে দুর্নীতিবিরোধী জাতিসংঘ কনভেনশনটি গৃহীত হলে ৯ ডিসেম্বর এই দিবসটি পালনের সিদ্ধান্ত হয়। ১৪০টি দেশ ওই কনভেনশনে স্বাক্ষর করে, যা ২০০৫ সালের ১৪ ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হয়। মূলত দুর্নীতি সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী সচেতনতা সৃষ্টির গুরুত্বকে স্বীকৃতি দেওয়ার মাধ্যমে জাতিসংঘ সেদিন ৯ ডিসেম্বরকে এই দিবসটি পালনের জন্য বেছে নেয়।
ওই কনভেনশনে বলা হয়েছে যে দুর্নীতি সমাজের স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার জন্য হুমকি সৃষ্টি করে; গণতান্ত্রিক কাঠামো, নৈতিক মূল্যবোধ ও ন্যায়বিচারকে ক্ষুণ্ন করে এবং টেকসই উন্নয়ন ও আইনের শাসনকে বিপন্ন করে। সুতরাং কনভেনশনকে আরো দক্ষতার সঙ্গে এবং কার্যকরভাবে দুর্নীতি প্রতিরোধ ও মোকাবেলা করার জন্য পদক্ষেপগুলোর উন্নয়ন এবং শক্তিশালী করার ক্ষমতা অর্পণ করা হয়েছে, যা দুর্নীতি প্রতিরোধ ও এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং প্রযুক্তিগত সহায়তার উন্নয়ন, সহায়তা ও সমর্থন এবং সততা, জবাবদিহি এবং সরকারি বিষয় ও সম্পত্তির সঠিক ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন ঘটাবে।
এই দিবসটি সারা বিশ্বের সরকার, বেসরকারি সংস্থা, রাজনীতিবিদ, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন, গণমাধ্যম এবং সাধারণ নাগরিকরা পালন করে থাকে। এ উপলক্ষে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকরভাবে লড়াই করতে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য বিভিন্ন অনুষ্ঠানের; যেমন—জনসমাবেশ, প্রচার-মিছিল, সভা ইত্যাদির আয়োজন করা হয়।
এ বছর আন্তর্জাতিক দুর্নীতি দমন দিবস পালনের থিম হচ্ছে ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুবকদের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হওয়া : আগামীর অখণ্ডতাকে গড়া’। দিবসটিতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য বিশ্ববাসীকে একত্র হওয়ার আহ্বান জানানো হবে। জাতিসংঘের উদ্যোগে এই দিনে সমাজ থেকে দুর্নীতি দূর করার জন্য সরকার, বেসরকারি খাত এবং ব্যক্তিবর্গের সম্মিলিত প্রচেষ্টার প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরা হবে। এ লক্ষ্যে প্রতিটি দেশ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো একসঙ্গে কাজ করার অঙ্গীকার করবে।
এবার দিবসটি পালনের এই থিমটি নির্বাচনের পেছনে যে বিশেষ কারণ রয়েছে তা হলো : ক. যুবকদের ক্ষমতায়ন—দুর্নীতিমুক্ত ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে যুবকদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার ওপর জোর দেওয়া; খ. বৈশ্বিক সংহতিকে অনুপ্রাণিত করার মাধ্যমেই দুর্নীতিবিরোধী সংগ্রামে সবাইকে একত্র করা সম্ভব হবে; গ. আইনি সংস্কারের উন্নয়ন করতে হলে শক্তিশালী দুর্নীতি রোধ সংক্রান্ত আইন ও নীতিমালা প্রণয়ন আবশ্যক এবং ঘ. শাসনব্যবস্থা এবং নেতাদের স্বচ্ছতা বা দায়বদ্ধতা বৃদ্ধি করা জরুরি। বলতে গেলে, এ বছর দিবসটি পালন সম্মিলিত পদক্ষেপকে যেমন অনুপ্রাণিত করবে, তেমনি যুবকদের দুর্নীতিবিরোধী লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিতে শক্তি জোগাবে। অন্যদিকে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি এবং ন্যায্যতার উন্নয়নের ফলে আমরা একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে সক্ষম হব।
জানা মতে, বাংলাদেশে তরুণের সংখ্যা ক্রমে বেড়েই চলছে। তরুণের সংখ্যা ২০০১ সালে ২৯ শতাংশ এবং ২০১১ সালে ২৯.৫ শতাংশ থাকলেও ২০২২ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৩.৫ শতাংশে।
অর্থাৎ বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশের বেশিই তরুণ। সম্প্রতি দেশের তরুণদের মধ্যে চালানো এক জরিপের তথ্য মতে, দেশের ৬৯.৪ শতাংশ তরুণ দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতিকে উন্নয়নের প্রধান বাধা হিসেবে দেখে থাকে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে যুবকদের ভূমিকা অপরিহার্য। তাই তাদের এড়িয়ে যাওয়া বা উপেক্ষা করার কোনো অবকাশ নেই। আর তারাই তো আগামীর বাংলাদেশকে উন্নয়নের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের সিপিআই অনুযায়ী দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান ২০২২ সালে নিচ থেকে ১২তম এবং ২০২১ সালে ১৩তম থাকলেও ২০২৩ সালে আরো নেমে যায়। অবশ্য এর আগের বছরগুলোতেও বাংলাদেশের অবস্থান খুব একটা ওঠানামা করেনি। বলতে দ্বিধা নেই, দুর্নীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর তালিকায় তার অবস্থান সুদৃঢ় রেখেই চলছে। বিগত সরকারগুলোর আমলে কখনোই দুর্নীতি দমনে খুব একটা কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে দেখা যায়নি।
বাংলাদেশে দুর্নীতি এরই মধ্যে একটি অপ্রতিরোধ্য মহামারিতে পরিণত হয়েছে। বাস্তবতা হলো, দুর্নীতি শুধু একজন ব্যক্তির নৈতিকতাকেই ধ্বংস করে না, এটি সমগ্র সমাজের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক রীতিনীতিকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এর কারণে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক কাঠামো, সরকারের কর্মক্ষমতা এবং একই সঙ্গে অর্থনৈতিক উন্নয়নকে দুর্বল করে দিয়েছে। দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হওয়ায় বাংলাদেশ কাঙ্ক্ষিত বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। এমনকি দুর্নীতির বেড়াজালে পড়ে দেশের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের বিকাশও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
বাংলাদেশে দুর্নীতিবাজদের বাহ্যিক আর অভ্যন্তরীণ রূপের অনুশীলন অবস্থা অনুযায়ী দৃশ্যমান হয়ে থাকে। মুখে সততার বুলি আওড়ালেও মনেপ্রাণে সে যে একজন দুর্নীতিবাজ, তা লোকে প্রকাশ্যে না বললেও কানাকানি যে হয় না, তেমন নয়। তবে তাদের নেটওয়ার্ক ধরতে পারলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের আসল রূপ বুঝতে আর কষ্ট হয় না। এই দুর্নীতিবাজরা দেশের ধনসম্পদ চুরি করে আমাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে শুধুই অস্থিতিশীল ও অনিশ্চিত করে তোলে না, দেশের অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করে উন্নয়নের গতি কমিয়ে দেয়। বাস্তবতা হলো, দুর্নীতি থেকে প্রাপ্ত অর্থ তারা সাধারণত দেশে রাখে না, পাচার করে থাকে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে আজ যে বিপর্যয় নেমে এসেছে, তার দায় যে তাদেরই।
আমরা দেশের সাধারণ মানুষ, যারা কিছু দুর্নীতিবাজের হাতে নাকানিচুবানি খাচ্ছি। সংগত কারণেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে আমরা কেন সেই দায়িত্বটি পালন করতে পারছি না? আসলে দুর্নীতিকে শূন্যের কোঠায় না হোক, অন্তত সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসা সম্ভব হলে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের যে পর্যায়ে রয়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি উন্নতি করতে পারত। বিগত বছরগুলোতে দুর্নীতি শুধু বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়নকেই বাধাগ্রস্ত করেনি, দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে অনেকটাই পঙ্গু করে দিয়েছে।
বলতে দ্বিধা নেই, দেশের উন্নয়নের সবচেয়ে বড় বাধা দুর্নীতি। সরকারকে সত্যিকার অর্থেই শূন্য সহনশীলতা নীতির বাস্তবায়ন করতে হবে। সর্বোপরি বাস্তবায়নে নিয়োজিত ব্যক্তিদের আন্তরিকতা, সদিচ্ছা, অঙ্গীকার ও সততা থাকতে হবে। অবশ্য এ ক্ষেত্রে দল-মত-নির্বিশেষে রাজনৈতিক নেতাদের সদিচ্ছা থাকা অপরিহার্য। এসবের একত্র প্রয়াস ছাড়া বাংলাদেশের মাটি থেকে এই মারাত্মক ব্যাধিকে নির্মূল করা কখনো সম্ভব হবে না।
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার একটি দুর্নীতিবিষয়ক সংস্কার কমিশন গঠন করে দিয়েছে। এরই মধ্যে তাদের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। দেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের পেছনে যুবকদের যে অফুরন্ত শক্তির প্রকাশ আমরা দেখেছি, সেই বিবেচনায় এবং আন্তর্জাতিক দুর্নীতি দমন দিবসটি পালনের বিষয়বস্তুর আলোকে বলার অপেক্ষা রাখে না যে এই যুবকদেরই দুর্নীতি প্রতিরোধে নেতৃত্ব দিতে হবে। তাদের যেমন দুর্নীতি দমন প্রক্রিয়ায় সঙ্গে নিয়ে অগ্রসর হতে হবে, তেমনি তাদের অনুপ্রাণিত করতে হবে দুর্নীতির মূলোৎপাটনে আপসহীন হয়ে কাজ করতে। হয়তো তারাই পারবে সমাজকে সঠিক নেতৃত্ব দিয়ে বাংলাদেশের মাটি থেকে চিরদিনের জন্য দুর্নীতিকে নির্মূল করে দিতে। তেমনি একটি বিপ্লব এ দেশের তরুণদের থেকে কি আমরা প্রত্যাশা করতে পারি না? আমরা দুর্নীতি নামের ওই আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতে দেশটিকে আর ধ্বংস হতে দেখতে চাই না।
Development by: webnewsdesign.com