পিতামাতার ভরণপোষণ আইন: অমান্যে জেল-জরিমানা

বুধবার, ১৪ অক্টোবর ২০২০ | ২:০৪ অপরাহ্ণ

পিতামাতার ভরণপোষণ আইন: অমান্যে জেল-জরিমানা
apps

পিতা-মাতার সেবা করা সন্তানের অন্যতম দায়িত্ব। যেমনভাবে সন্তানের লালন পালন পিতা-মাতার দায়িত্ব। জন্মগ্রহণের পর শিশুর প্রধাণ ও একমাত্র আশ্রয়স্থল পিতা-মাতা। শৈশব থেকে কৈশোর, কৈশোর থেকে যুবক এবং প্রতিষ্ঠিত হওয়া পর্যন্ত পিতামাতার লালন পালনে থাকে। পিতামাতা‍ জীবনের অমূল্য সম্পদ। কিন্তু বর্তমানে বৃদ্ধ পিতা-মাতার আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছে বৃদ্ধাশ্রম। এমন অনেক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৩ সালের ২৭ অক্টোবর জাতীয় সংসদে পাশ হয় পিতামাতার ভরণপোষণ আইন। যা পরবর্তীতে বাধ্যতামূলক করা হয়।

আমাদের সমাজে পরিবার প্রথাটি অনেক পুরোনো। যার মূল ভিত্তি স্বামী-স্ত্রী। স্বামী স্ত্রীর জৈবিক সম্পর্কের ফলে যে সন্তান জন্মলাভ করে মূলত তারাই সেই সন্তানের পিতা-মাতা। এছাড়া অনেক নিঃসন্তান হওয়ায় কিংবা ইচ্ছাকৃত সন্তান দত্তক নিয়ে থাকেন। এই প্রথাটি মূলত হিন্দু ধর্ম থেকে এসেছে। সন্তানের লালনপালন পিতা-মাতাই করেন এবং পিতা-মাতার মৃত্যুর পরে সকল সম্পত্তির উত্তরাধিকার ঐ সন্তানই হয়ে থাকে।

এক্ষেত্রে ধর্ম ভেবে আলাদা আলাদা উত্তরাধিকার আইন রয়েছে। সন্তানের সাথে পিতা-মাতার রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক। পিতামাতা ও সন্তানের সম্পর্ককে সব থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দিয়েছে বিভিন্ন ধর্ম। একসময় সন্তানের নৈতিক দায়িত্ব ছিল কিন্তু বর্তমানে আইন করে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এর কারণ বৃদ্ধ পিতামাতাকে নির্যাতন এবং আর কোনো প্রতিকার না থাকায় ও বৃদ্ধাশ্রমে প্রেরণ করার ফলে।

ষাটোর্ধ্বদের সিনিয়র সিটিজেন বলা হয়। ২০১৪ সালের ২৭ নভেম্বর বিশ্ব প্রবীণ দিবসে দেশের ১ কোটি ৩০ লাখ প্রবীণ নাগরিককে সিনিয়র সিটিজেন ঘোষণা করেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রতি বিভাগে সরকারি ও বেসরকারী ভাবে বৃদ্ধাশ্রম রয়েছে। এসব বৃদ্ধাশ্রমে ক্রমাগত বৃদ্ধের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। যা আসলে আমাদের জন্য অশনী সংকেত।

বর্তমানে কাউকে আর ঠাকুমার ঝুলি বলার জন্য বাসায় রাখতে চায় না। অথচ একটি সময় ছিল যখন শিশুদের শৈশব আর কৈশোর পরিতৃপ্তি পেত দাদা ও নানা বাড়িতে বেড়াতে গেলে। চাকরির পরিসংখানের কথা বললে সাধারণত ষাটোর্ধ্ব বয়সের বেশী কোনো চাকরি নেই। চাকুরীহীন বৃদ্ধরা এসময়ইটায় অসহায় বললেই চলে। সরকারি চাকুরীর ক্ষেত্রে পেনশন সম্বল হয় কিন্তু বেসরকারি কিংবা প্রাইভেটে এমন সুবিধা নেই।

পিতামাতাকে ভরণপোষণের বিষয়টি আইনত বাধ্যতামূলক করার আগে ধর্মীয় ও নৈতিক বিষয় ছিল। সামাজিক রীতিনীতি ছিল। একসময় এই দেশে বৃদ্ধাশ্রম বলতে কিছুই ছিল না। আশ্রম ছিল যেখানে সন্যাসীরা থাকত। ইসলাম ধর্মে পিতামাতার মর্যাদা ও ভরণপোষণ দেওয়া আছে।

মাতা-পিতার হক সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন: ‘আর তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর, তার সঙ্গে কোন বস্তুকে শরীক করো না এবং মাতা-পিতার প্রতি উত্তম আচরণ কর।’ (নিসা ৩৬)

এছাড়া হজরত আবু হুরায়রা থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করল ‘ইয়া রসুলুল্লাহ! আমি সর্বাগ্রে কার সঙ্গে সদাচরণ করব? রসুল (সা.) বলেন, তোমার মায়ের সঙ্গে। লোকটি প্রশ্ন করল, তারপর? উত্তর এলো তোমার মা। লোকটি আবার জানতে চাইল অতঃপর কে? রসুল (সা.) এবারও জবাব দিলেন তোমার মা। ওই লোক চতুর্থবার একই প্রশ্ন করলে রসুল (সা.) বলেন, তোমার পিতা।’ (বোখারি ও মুসলিম)।

এছাড়াও বিখ্যাত পীর হযরত আব্দুল কাদের জিলানী ও তার মায়ের বিষয়টি আমরা সবাই জানি। হিন্দু ধর্মগ্রন্থে উল্লেখ আছে ‘জননী স্বর্গ অপেক্ষা গরীয়সী। পিতা স্বর্গ, পিতা ধর্ম, পিতাই পরম তপস্যার ব্যক্তি।’ খ্রিস্টান ধর্মে জিসু (ঈসা আঃ) উনার মাতা মরিয়া ( মরিয়ম আঃ) পবিত্রতার কথা আজীবন বলেছেন। বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ ত্রিপিটকে বলা হয়েছে ‘মাতাপিতার সেবা করাই সবচেয়ে উত্তম।’

কিন্তু বর্তমানে সামাজিক ও নৈতিক শিক্ষা ভুলে মানুষ পিতামাতাকে ভুলে বসেছে। মানুষ অকৃজ্ঞত ও কৃতঘ্ন না হলে এমন পর্যায় আসে না। যার ফলে বাংলাদেশের সরকার পিতামাতার ভরণপোষণ আইন ২০১৩ প্রণয়ন করেছে। আইনের ২ ধারা অনুযায়ী জন্মদাতা পিতা ও মাতা এই আইনের আওতাভুক্ত হবেন। ভরণপোষণের বিষয়ে উক্ত আইনের ৩ ধারায় স্পষ্ট বলা হয়েছে, পিতামাতার ভরণপোষণের বিষয় সন্তান নিশ্চিত করবে এবং একাধিক সন্তান থাকলে আলাপ আলোচনা করে নিশ্চিত করবে।

পিতামাতার সকল সেবাদানে বিষয়ে সন্তান পরস্পরের সাথে আলোচনা করে পরস্পরের স্থান থেকে কাজ করবেন। ৪ ধারা অনুযায়ী দাদা-দাদী ও নানা-নানী থাকলে পিতামাতার অবর্তমানে তাদের ৩ ধারা অনুযায়ী সেবাদাবে ব্যধ্য। আইন অমান্যে রয়েছে শাস্তি। কেউ যদি এই আইন অমান্য করে তবে তাকে এক লক্ষ টাকার অর্থদণ্ড, অনাদায়ে তিন মাসের জেলের বিধান করা হয়েছে। একটি আমলযোগ্য, জামিন যোগ্য ও আপোষ যোগ্য মামলা করা হয়েছে।

উক্ত আইনের ৮ ধারায় বর্ণিত, আপোষ নিষ্পত্তির ক্ষমতা স্থানীয় সরকার পরিষদকে দেওয়া হয়েছে। তবে উক্ত মামলার ক্ষেত্রে পিতা অথবা মাতাকেই বাদী হয়ে মামলা করতে হবে। যেখানে বৃদ্ধ পিতামাতাই সন্তানের কাছে জিম্মি হয়ে থাকে সেখানে থানায় কিংবা আদালতে মামলা করা অনেক সাহস ও সামর্থ্যের ব্যাপার। যার ফলস্বরূপ বাংলাদেশে এমন আইনের বাস্তবায়ন তেমন নজির নেই। কিন্তু গণমাধ্যমে প্রকাশ হবার পরে প্রশাসনের উদ্যোগে অনেক অত্যাচারী সন্তানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

লেখক-
শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ,
বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়।

Development by: webnewsdesign.com