পলিব্যাগ ও প্লাস্টিক পুড়িয়ে গ্যাস ও তেল তৈরী করলেন কৃষক

শুক্রবার, ২৫ ডিসেম্বর ২০২০ | ৬:৩৭ অপরাহ্ণ

পলিব্যাগ ও প্লাস্টিক পুড়িয়ে গ্যাস ও তেল তৈরী করলেন কৃষক
apps

নওগাঁয় কৃষক ফজলুর রহমান তার উদ্ভাবিত নিজস্ব পদ্ধতিতে বর্জ্য ব্যবহার করে উৎপাদন করছেন গ্যাস ও তেল। আমাদের পরিবেশের জন্য হুমকি পলিথিন বর্জ্য। নিষিদ্ধ হওয়ার পরও আমাদের দৈনন্দিন জীবনে পলিব্যাগ ও প্লাস্টিক অত্যাবশ্যকীয় উপকরণ হওয়ায় এসব থেকে মুক্তি মিলছে না। আবার পলিথিন ও প্লাস্টিক যত্রতত্র ফেলে দেওয়ার কারণে এবং সহজে পচনশীল না হওয়ায় আমাদের চারপাশের কৃষিজমি, নদী-নালা, খাল-বিল, ড্রেনেজ ব্যবস্থা ধ্বংসের মুখে। জমির উর্বরা শক্তিসহ নানাভাবে চারপাশের ভূমিকে হুমকির দিকে ঠেলে দিচ্ছে এসব পলিথিন ও প্লাস্টিক। কিন্তু এই পরিত্যক্ত পলিথিন ও প্লাষ্টিক কাজে লাগিয়ে চেষ্টা এবং সাধনার মাধ্যমে তেল ও বায়োগ্যাস উৎপাদন করতে সক্ষম হয়েছেন কৃষক ফজলুর রহমান।

বদ্ধ ড্রামের ভিতর আগুনে গলছে পরিত্যক্ত পলিথিন ও প্লাস্টিক। তরল করা সে পলিথিন ও প্লাস্টিক বাষ্পীভূত হয়ে পাইপ দিয়ে বের হচ্ছে ফোঁটায় ফোঁটায়। পরে পরিশোধিত হয়ে সিলিন্ডারে বিন্দু বিন্দু করে জমে তৈরি হচ্ছে অকটেন, পেট্রোল, ডিজেল ও বায়োগ্যাস। চারপাশে ফেলে দেওয়া পরিত্যক্ত পলিথিন ও প্লাস্টিক আগুনে গলিয়ে অকটেন, পেট্রাল, ডিজেল, বায়োগ্যাস তৈরির মাধ্যমে আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন নওগাঁ সদর উপজেলার হাঁসাইগাড়ী ইউনিয়নের কাটখইর গ্রামের ফজলুর রহমান। তার এই অভিনব জ্বালানি তেল-গ্যাস আবিষ্কার দেখতে শত শত মানুষ ভিড় জমাচ্ছেন ফজলুর রহমানের বাড়িতে।

জানা যায়, নওগাঁ সদর উপজেলার হাঁসাইগাড়ী ইউনিয়নের কাটখইর গ্রামের ফসিম উদ্দিন মোল্লার ছেলে ফজলুর রহমান নিজ বাড়ির সামনেই একটি বদ্ধ তেলের ড্র্রামের সঙ্গে পাইপের মাধ্যমে তিনটি সিলিন্ডারে সংযোগ দেয়া হয়েছে। সাথে যুক্ত করা হয়েছে তিনটি হিট মিটার। ড্রামের ভিতর প্লাস্টিক ও পলিথিন ভরে ড্রামের মুখ বন্ধ করে নিচে আগুন জ্বালিয়ে তা গলানো হচ্ছে। জ্বলছে পলিথিন ও প্লাস্টিক প্রায় ২৫/৩০ মিনিট ধরে উচ্চতাপ প্রয়োগে প্লাস্টিক ও পলিথিনগুলো পুরোপুরি গলে বাষ্প আকারে পাইপের মাধ্যমে বাষ্পীভূত হয়ে বিন্দু বিন্দু আকারে সিলিন্ডারে জমছে ডিজেল-পেট্রোল-অকটেন।

অপর একটি পাইপের মাথা দিয়ে বেরিয়ে আসছে বায়োগ্যাস। যা ড্রামের তলায় দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে অন্য কোনো জ্বালানি ছাড়াই গলানো হচ্ছে প্লাস্টিক-পলিথিন। প্রতিটি সিলিন্ডারের নিচের অংশে বিবকর্ক যুক্ত করা আছে যার মাধ্যমে তেল ভর্তি হলে বার প্রয়োজনে সেখান দিয়েও বোতলে তেলগুলো সংরক্ষণ করা যায়। প্লাস্টিক ও পলিথিন গলানোর কারণে যে অবশিষ্ট পানি বের হয় তা অন্য একটি পাইপ যুক্ত করা হয়েছে।

সেখান দিয়ে পাশের ডোবাতে পানিগুলো ফেলা হয়। পরিত্যক্ত প্লাস্টিক-পলিথিন থেকে উৎপাদিত জ্বালানি তেল নিজস্ব মোটসাইকেলে ব্যবহার করার পাশাপাশি গ্রামবাসী, স্বজন-বন্ধু বান্ধবদেরও দিচ্ছেন ব্যবহারের জন্য। জনসম্মুখে তার আবিষ্কৃত জ্বালানি অকটেন, পেট্রোল ও বায়োগ্যাস তৈরি করে ব্যতিক্রমী এ উদ্ভাবন চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে এলাকায়।

স্থানীয় কাটখইর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জনাব আলী বলেন, ফজলুর রহমানের পলিথিন ও প্লাস্টিক দিয়ে তেল ও গ্যাস তৈরি করার উদ্ভাবনী দেখে খুবই অবাক হয়েছি। তার এ বিষয়ে কোন পড়াশোনা না থাকলেও শুধু ইচ্ছা শক্তি, মেধা ও দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে আজ সে সফল ভাবে তেল ও গ্যাস উৎপাদন করছে। সরকার যদি তাকে সহায়তা করে তাহলে আরও ব্যাপক সুফল পাবে এলাকাবাসী।

উদ্ভাবক ফজলুর রহমান বলেন, ছোটবেলা থেকেই কৌতূহল ছিল তেল ও গ্যাস কিভাবে উৎপাদন করা হয়। গ্রামের চাল সিদ্ধ করা যে সব চাতাল রয়েছে সেখানে যে ড্রামে আগুন দেয়া হয় সেখানে আমি মাঝে মাঝে আর্বজনা ও পলিথিন দিতাম সেগুলো পোড়ার পর সেখান থেকে এক ধরনের পানির মত তরল পদার্থ বের হতো। তাছাড়া গ্রামের মানুষ খড়কুটোর পাশাপাশি প্লাস্টিক পোড়ালে ফোঁটা-ফোঁটা আকারে কিছু পদার্থ বের হতো। তখন থেকেই মাথায় বিষয়গুলো ঘুরপাক খেতো।

তিনি বলেন, স্থানীয় কুজাগাড়ী হাফেজিয়া মাদ্রাসা থেকে ১৯৯২ সালে হেফজ (হাফেজ) পাশ করার পর আর বেশি দূর পড়াশোনা করা হয়নি। পাঁচ ভাই ও এক বোনের মধ্যে আমি সবার বড়। অভাব অনটনের কারনে বেশি দূর পাড়াশুনা করতে পারিনি। সংসারের হাল ধরতে ড্রাইভিং ট্রেনিং নিয়ে ঢাকাতে নিজের মাইক্রো চালাতাম।

এরপর ২০১৭ সালে একটি সড়ক দুর্ঘটনায় মারাত্মকভাবে আহত হওয়ার পর মাইক্রোটি বিক্রি করে দিয়ে গ্রামে চলি আসি। এরপর কৃষি কাজ শুরু করি। তারপর ২০১৯ সালের শেষের দিকে নারায়ণগঞ্জে একটি ব্যক্তিগত কাজের জন্য গিয়েছিলাম। তারপর সেখানে একজনের কাছে গিয়ে পলিথিন ও প্লাস্টিক পুড়িয়ে জ্বালানি তৈরি করা দেখে মনের ভিতর আবার সেই ছোটবেলার কৌতূহল ভর করে বসলো। তার উদ্ভাবনী বিষয়গুলো আয়ত্ব করে গত কয়েক মাস ধরে অনেক কষ্ট করে ১ লাখ ৭০ হাজার টাকার কিছু যন্ত্রাংশ কিনে নিজেই স্থাপন করে পরিক্ষামূলকভাবে জ্বালানি তেল ও বায়োগ্যাস উৎপাদন করতে আজ সক্ষম হয়েছি।

তিনি আরো বলেন, উৎপাদিত জ্বালানি তেল দুটি পদ্ধতিতে পরিশোধন করা হয়। এক ছাকন পদ্ধতি এবং দুই থিতানো পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে এক কেজি পলিথিনে ৫শ গ্রাম ও প্লাস্টিক থেকে ৬ থেকে ৭শ গ্রাম জ্বালানি তেল উৎপাদিত হয়। এতে খরচ হয় মাত্র ২০ থেকে ২৫ টাকার মত। আর একই সাথে বায়োগ্যাস উৎপাদন করা যায়। এই তরল পদার্থগুলো হাইড্রোকার্বন ও এগুলোর বর্ণ ডিজেল-পেট্র্রোল-অকটেন এবং নির্গত বায়োগ্যাসের মতো। সরকারি-বেসরকারিভাবে সহযোগিতা পেলে জ্বালানি খরচে নতুন মাত্রা যোগ করার পাশাপাশি প্লাস্টিক ও পলিথিনের অপব্যবহারে পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি কমিয়ে আনা সম্ভব বলেও জানান তিনি।

নওগাঁ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মির্জা ইমাম উদ্দিন বলেন, ফজলুর রহমানের আবিষ্কারটা একটু ব্যতিক্রম মনে হয়েছে। পরিত্যক্ত পলিথিন ও প্লাস্টিক পুড়িয়ে সেখান থেকে ডিজেল, অকটেন, পেট্রোল ও বায়োগ্যাস উদ্ভাবন করেছে। এ বিষয়ে যে ধরনের সহযোগিতা চাইলে আমি ও উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সেই সহযোগিতা করবো।

Development by: webnewsdesign.com