নিঃসঙ্গ জীবন ছিল মৃত্যুর আগে মারাদোনার

মঙ্গলবার, ২৯ নভেম্বর ২০২২ | ৩:০৬ অপরাহ্ণ

নিঃসঙ্গ জীবন ছিল মৃত্যুর আগে মারাদোনার
apps

আর্জেন্টিনা থেকে অনেক সাংবাদিক এসেছে কাতারে বিশ্বকাপ ফুটবল কাভার করতে। অনেকের সঙ্গেই কথা হয়। প্রশ্ন ওঠে ম্যারাডোনা বিষয়ে-‘মারাদোনা? প্লিজ ডোন্ট টেল মি (আমাকে কিছু বলো না)।’ ফুটবল দুনিয়ায় কেউ ম্যারাডোনা বলে না। মারাদোনা। আর্জেন্টিনার শত্রুও মারাদোনাকে পছন্দ করেন। ভালোবাসেন। ২০২০ সালে ২৫ নভেম্বর পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন তিনি। সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল মৃত্যুর আগে কেমন ছিল মারাদোনার দিনগুলো, কেটেছিল কীভাবে?

আর্জেন্টিনার ফুটবলের পেটের সব খবর জানা আছে আর্জেন্টাইন সাংবাদিক সার্জিও লেভনস্কির। এই সাংবাদিক আগামী ফেব্রুয়ারিতে ৬০ বছর পূর্ণ করবেন। ১০টা বিশ্বকাপ ফুটবল কাভার করেছেন তিনি। তার কাছে সব খবরই জানা যায়। ব্রাজিলে ২০১৪ বিশ্বকাপে পরিচয়। দোহায় দেখা হওয়া মাত্রই হাই বলে হাত তুললেন। নানা খবর জানতে চেয়ে প্রশ্নটা তুললাম ম্যারাডোনাকে নিয়ে। কথাটা শুনেই আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়লেন তিনি। বললেন,‘মারাদোনা? আমি ও আমার স্ত্রী আমরা সাত দিন কেঁদেছি। আমার স্ত্রী টিভিতে খবরই দেখেনি। আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না মারাদোনা এভাবে চলে যাবে। মারাদোনা নেই, এখন বিশ্বকাপে এসেছি। মনে হচ্ছে প্লেট আছে, প্লেটে খাবার নেই।

সার্জিওর চোখে ভারী চশমা। গায়ের রং ফরসা। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। বয়সের ভার বুঝা যায়। বাংলাদেশ ভারতসহ পৃথিবীর প্রায় সাংবাদিকই তাকে চেনেন। আর্জেন্টিনার খবর জানতে চাইলে তাকে টোকা দিলেই বেরিয়ে আসে। বিশেষ করে মারাদোনার খবর তো আছেই।

মারাদোনার কথা বলতে গিয়ে সার্জিওর কণ্ঠে উঠে এলো শেষ দিনগুলোর নিঃসঙ্গতার গল্প। আকাশ ছোঁয়া খ্যাতির চূড়ায় থাকা মারাদোনার স্ত্রী পুত্র, কন্যা থাকার পরও ছিলেন নিঃসঙ্গ। সার্জিও বললেন, ‘মৃত্যুর আগে তিন চার বছর ভালো ছিলেন না দিয়েগো। একাকী জীবন কাটিয়েছেন তিনি।’ কিন্তু এত বড় মাপের একজন ফুটবলার। কেন তিনি একাকী জীবন কাটাবেন।

তার চার পাশে লোকজনে পূর্ণ থাকার কথা। মুখের কথা কেড়ে নিয়ে সার্জিও বললেন, ‘এটাই তো সমস্যা।’ কিছু বলতে না দিয়ে তুলে আনলেন অজানা নানা কথা। মারাদোনা মৃত্যুর আগের তিন বছর কিছু মানুষের পাল্লায় পড়ে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন।

যারা মারাদোনার ভালো চাইতেন তারা কখনো মারাদোনার কাছে আসতে পারতেন না। সার্জিওর সঙ্গে কথা বলে যেটা মনে হলো মারাদোনোর তারকা খ্যাতিটাকে ব্যবহার করে কিছু মানুষ সম্পদ গড়েছে। মারাদোনা এমন মানুষ ছিলেন যিনি মানুষের ভালোবাসাকে মূল্যায়ন করতেন। তার ইজেমটাকে কাজে লাগানোর জন্য বড় বড় প্রতিষ্ঠানের আগ্রহ ছিল।

সেগুলো ব্যবহার করেছেন বন্ধুরা। মারাদোনার অনেক সম্পদ ছিল। যা অনেকেই জানতেন না, অনেক কিছুই এখন নেই। ঘরের মধ্যেও ছিল ব্যবহারের দামি দামি সম্পদ। সেগুলো কোথায়। মারাদোনা সবার সঙ্গে মিশতেন, কথা বলতেন। বন্ধুরা তার উদারতা কাজে লাগিয়েছে। নেশার মধ্যে ডুবে থাকার পথও মসৃণ করে দিয়েছেন।

সার্জিও বললেন, ‘মারাদোনাকে কেউ ফোন করলে পেত না। যখনই কেউ ফোন দিয়েছে, ওপর প্রান্ত হতে বলা হলো সে নেই। কখনো বলা হতো ব্যস্ত রয়েছেন দিয়েগো।’ সার্জিও পালটা প্রশ্ন করলেন, ‘তোমাকে যদি কেউ একবার দুইবার ফোন করে না পায় তাহলে সে কি আর ফোন করবে।

এই সাংবাদিক বলছিলেন, ‘৮৬ মেক্সিকো বিশ্বকাপ ফুটবলে আর্জেন্টিনা দলের খেলোয়াড় ছিলেন এনরিক। তার সঙ্গে আমার কথা হতো। সেই আমার কাছে জানতে চাইল মারাদোনার কি হয়েছে। আমি বললাম কেন কেন। সে বলল যখনই ফোন করি দিয়েগো ব্যস্ত। আবার ফোন করি সে তখনো ব্যস্ত। কয়েক দিন পরে আবার ফোন করলাম, তখনো বলা হলো সে ব্যস্ত। একটা দিনও পাইনি। আমি তার বন্ধু, সেটা জেনেও কলব্যাক করছে না। এনরকি জানতে চাইলেন ফোনটা কে রিসিভ করছে। চিনি না, জানতে চাইলেও পরিচয় বলতে রাজি না। কথা বলতে গেলে এড়িয়ে যান, ফোন কেটে দেন।’

মারাদোনার সঙ্গে খেলেছেন, তার বিদেশি বন্ধুরা রয়েছেন। মারাদোনার খোঁজ নিতে গেলে এরা ব্যর্থ হতেন। একাধিক ফুটবলার মারাদোনাকে খুঁজে পাননি বলে খবর আছে সার্জিওর কাছে। সার্জিও বললেন, ‘কেউ ফোন করলে বলা হতো দিয়েগো ঘুমাচ্ছেন। বলা হতো ব্যস্ত আছেন। বলা হতো মিটিংয়ে রয়েছেন। কিছু লোক কিংবা বন্ধু, এরাই মারাদোনোকে ঘিরো রাখতো,কারো সঙ্গে কথাও বলতে দিত না।

কেউ যোগাযোগ করলে এখন সময় নেই জানিয়ে ফিরিয়ে দেওয়া হতো। এমন পরিস্থিতিতে ধীরে ধীরে দিয়েগো বিচ্ছিন্নই হয়ে গিয়েছিলেন। সবচেয়ে অবাক লাগত, সন্তানরা ফোন করলেও পেত না।’ সার্জিও বললেন, ‘দিয়েগো কখন কোন ফোন নম্বর ব্যবহার করতেন, তা কেউ জানতেন না। একেক সময় একেকটা নম্বর ব্যবহার করতেন। দিয়েগোর হাতে ফোনও থাকত না। ফোন থাকত দিয়েগোর চার পাশের লোকের কাছে। তারা ফোন দিলে দিয়েগো মনে করতেন কেউ তাকে খুঁজছে।

কিন্তু কেনই বা দিয়েগো এমনটা করতেন। সার্জিওর মতে মৃত্যুর আগের কয়েক বছর দিয়েগো তার বাবা মায়ের কথা খুব বেশি মনে করতেন। একটা হতাশা ছিল। নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখারও একটা প্রবণতা ছিল। মৃত্যুর আগে নিঃসঙ্গ জীবন ছিল মারাদোনার। মন্দ লোকেরা সেটাকে কাজে লাগিয়ে ফায়দা তুলে নিয়েছে।

Development by: webnewsdesign.com