রাজধানীর কুর্মিটোলায় রাস্তা থেকে ধরে নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীকে ধর্ষণের ঘটনা আগামী সপ্তাহে আদালতে চার্জশিট দিবে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। এজন্য নানা ধরনের আলামতের ফরেনসিক পরীক্ষার প্রতিবেদনও পুলিশের হাতে এসেছে। প্রতিবেদনে পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে- ধর্ষক মজনুই এবং চাঞ্চল্যকর ওই কান্ডে সে একাই জড়িত। এই মামলায় সাক্ষী হিসেবে রাখা হচ্ছে ধর্ষণের শিকার ছাত্রীর মোবাইল ফোন ক্রেতা অরুণা বিশ্বাস ও খায়রুলকে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উত্তর বিভাগ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
এদিকে খোদ রাজধানীর সড়কে এমন কান্ডে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মজনু নামে ভবঘুরে যুবককে ধর্ষক হিসেবে গ্রেপ্তার করলে সন্দেহের ডালপালা মেলে। এরপরও শুরু হয় নতুন সমালোচনা, কানাঘুষা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ধর্ষণকান্ডে ডিবি পুলিশ জড়িত বলে প্রচার প্রচারণা চালানো হয়। এতে পুলিশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হওয়ায় অথীত সরকার নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক ছাত্রকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। অথীত সরকারের দাবি আর্থিক সচ্ছলতা ফিরিয়ে আনতে তিনি ইউটিউব চ্যানেলে এসব গুজব ছড়ান। তার ধারণা ছিল ইউটিউব চ্যানেলটি ভাইরাল হলে সেখান থেকে তিনি কিছু টাকা উপার্জন করতে পারতেন।
জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার মশিউর রহমান যায়যায়দিনকে বলেন, মেয়েটির হারানো মোবাইল ফোনের অরজিনাল ইকুপমেন্ট উদ্ধার করা হয়েছে। এছাড়া কেমিক্যাল ও বায়োলজিক্যাল টেস্ট, ভিকটিমের কাপড়-চোপড়ে প্রাপ্ত ডিএনএ ও মজনুর ডিএনএ একই বলে রিপোর্ট ম্যাচ করেছে। এছাড়া এ ঘটনায় মজনু আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। এছাড়া ঘটনার শিকার মেয়েটির দেওয়া জবানবন্দিতেও মজনু একাই বলে উঠে এসেছে। পাশাপাশি মামলায় সাক্ষী হিসেবে মোবাইল ফোন ক্রেতা অরুণা ও খায়রুলের বর্ণনায়ও মজনু বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। সব মিলিয়ে তদন্ত শেষ পর্যায়ে। আসা করছি আগামী সপ্তাহের শুরুতেই এই মামলার অভিযোগপত্র আদালতে জমা দেওয়া সম্ভব হবে। পাশাপাশি গুজব ছড়ানোর জন্য এক ঢাবি ছাত্রকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট অপর একজন কর্মকর্তা বলেন, মজনুকে গ্রেপ্তারের আগে ঘটনার শিকার মেয়েটির মোবাইল ফোন পাওয়া যায় অরুণা বিশ্বাস নামের এক নারীর কাছে। ওই নারীকেওর্ যাব গ্রেপ্তার করে। পরে সে জিজ্ঞাসাবাদে জানায় খায়রুল নামের একজনের কাছ থেকে সে ফোনটি কিনেছে। এরপর খায়রুলকে গ্রেপ্তার করা হলে সে মজনুর কথা জানায়। পরে ওই দুজন আদালতে স্বীকারোক্তি জবানবন্দি দিয়ে ফোনের মালিক হিসেবে মজনুর নাম জানায়। আসামি মজনুও খায়রুলের কাছে ফোন বিক্রির কথা স্বীকার করে। এজন্য ধর্ষণ মামলার চার্জশিটে তাদের আসামি হিসেবে দেখানো হবে না। তাদের মামলার একটি অংশের সাক্ষী হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে।
ওই কমকর্তা বলেন, অনেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘটনা নিয়ে গুজব ছড়িয়েছিল। গুজব সৃষ্টিকারীদের অন্যতম অথীত সরকার নামে ঢাবির এক ছাত্রকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বর্তমান ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলায় তিনি জেলে রয়েছেন।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত-উপ পুলিশ কমিশনার মো. জুনায়েদ আলম সরকার যায়যায়দিনকে বলেন, ওই ছাত্র আর্থিকভাবে অসচ্ছল। এ কারণে সে ফেসবুকে ও ইউটিউব চ্যানেলে ধর্ষণে ডিবি জড়িত বলে প্রচার চালায়। এতে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি হয়। অথীত সরকারের ধারণা ছিল ইউটিউব চ্যানেল থেকে সে কিছু আর্থিক সহায়তা পেতে পারে। কারণ ইউটিউব কর্তৃপক্ষ সর্বোচ্চ ভিউয়ার্স চ্যানেলের মালিককে পেমেন্টে করে থাকেন। তার এমন প্রচারণার কারণে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
জানা গেছে, মজনু পথশিশু, ভিক্ষুক নারী ও প্রতিবন্ধী নারীদের ধরে নিয়ে দীর্ঘ সময়ে তাদের সঙ্গে থেকেছে। এসব নারীর সঙ্গে দৈহিক সম্পর্ক স্থাপন করেছে। এসব ঘটনাকে সে অপরাধ হিসেবেই জানত না। তাছাড়া আগের ঘটনাগুলো নিয়ে কেউ অভিযোগও করেনি। এসব কর্মকান্ডের কারণে মজনু যৌন রোগে ভুগছিল। ঘটনার দিন তিনি কুর্মিটোলা হাসপাতালের সামনে থেকে যৌন রোগের ওষুধ কেনেন। এরপর সেটি সেবন করে রাস্তায় অপেক্ষা করছিল। হঠাৎই ঢাবি ছাত্রী তার নজরে পড়ে। এরপর তাকে জোর করে তুলে নিয়ে ঝোপের মধ্যে ধর্ষণ করে। ঢাবি ছাত্রী তার ভুল টার্গেটের শিকার হয়েছিলেন।
গত ৫ জানুয়ারি ওই ছাত্রী কুর্মিটোলার অদূরে শেওড়া এলাকায় বান্ধবীর বাসায় যেতে ক্যাম্পাসের বাসে উঠেছিলেন। সন্ধ্যার দিকে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল ও গলফ ক্লাব সংলগ্ন সড়কে নামেন তিনি। এরপর এক দুর্বৃত্ত তার মুখ চেপে জোর করে টেনে নিয়ে যায় এবং ঝোপের মধ্যে নিয়ে ধর্ষণ করে। এক পর্যায়ে অচেতন হয়ে পড়েন তিনি। ঘটনার অন্তত তিন ঘণ্টা পর রাত ১০টার দিকে চেতনা ফিরলে মেয়েটি সেখান থেকে পালিয়ে আসেন। স্বজনরা ঘটনা জানার পর তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে ভর্তি করে। ওই ঘটনায় ছাত্রীর বাবা রাজধানীর ক্যান্টনমেন্ট থানায় অজ্ঞাত পরিচয়ে ব্যক্তিকে আসামি করে মামলা করেন। এরপর পুলিশ ওর্ যাবসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন সংস্থা ধর্ষককে শনাক্ত করে গ্রেপ্তারে মাঠে নামে। শেষ পর্যন্ত ঘটনা জানাজানির তিন দিনের মাথায়র্ যাব-১ এর একটি দল রাজধানীর কাওলা এলাকা থেকে ভবঘুরে মজনুকে গ্রেপ্তার করে। ওইদিনই সংবাদ সম্মেলন করের্ যাবের পক্ষ থেকে বলা হয়, গ্রেপ্তার মজনু একজন সিরিয়াল রেপিস্ট (ক্রমিক ধর্ষক)। এর আগেও সে একাধিক ভবঘুরে, ফুটপাতে থাকা প্রতিবন্ধী নারীকে ধর্ষণ করেছে। গ্রেপ্তারের পর সে ঢাবি ছাত্রীকে ধরে নিয়ে ধর্ষণের কথা স্বীকার করেছে। ঘটনার শিকার মেয়েটিও ছবি দেখে মজনুকে ধর্ষক হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
অবশ্য ঘটনার পর ছাত্রীকে উদ্ধৃত করে তার স্বজনদের বয়ানে ধর্ষকের দৈহিক গঠনের বিবরণ এবং ঘটনার যে বিবরণ কোনো কোনো গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়- তাতে গ্রেপ্তার মজনুর দৈহিক গঠন নিয়ে ‘বিভ্রান্তি’ তৈরি হয়। ‘গ্রেপ্তার ব্যক্তি ধর্ষক হতে পারে না’- সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এমন গুজবও ছড়িয়ে পড়ে।
Development by: webnewsdesign.com