যুদ্ধ যখন শুরু হলো তখন আমি নেদারল্যান্ডসে। বোনের বাড়িতে বেড়াতে গেছি। গত দুই বছরের মধ্যে এটা ছিল আমার প্রথম বিদেশ যাওয়া। সময়টা দারুণ কাটছিল। এরপর সেদিন সকালটা আমার জন্য যেন অভিশাপ হয়ে এলো। ঘুম থেকে যথারীতি জেগে উঠলাম। অভ্যাস মতো ফোনটা হাতে নিলাম। রাতের বেলায় ফোনের সাউন্ড অফ ছিল। খুলতেই অনেক মিসড কল আর মেসেজ দেখতে পেলাম।
ইউক্রেনে রাশিয়া বোমা হামলা শুরু করেছে- মেসেজগুলো সেই বার্তায় নিয়ে এসেছে। সরাসরি বিমানে করে ইউক্রেনে ফিরতে পারলাম না আমি। তাই রোমানিয়ায় যাওয়ার জন্য ফ্লাইটে টিকিট বুকিং করলাম। ওখান থেকে সীমান্ত পার হয়ে ইউক্রেনের পশ্চিমাঞ্চলে আমার নিজের শহর চেরনিভৎসি পৌঁছানো সহজ। কবে সীমান্ত পেরিয়ে বাড়ি ফিরতে পারব সেই চিন্তায় দিন গুনতে লাগলাম আমি। ইউক্রেনের তিনটা জায়গা রয়েছে যেগুলোকে আমার সত্যিকার অর্থে নিজের বাড়ি বলেই মনে হয়। চেরনিভৎসি শহর আর রাজধানী কিয়েভ। গত ২৫টি বছর ধরে এই দুই শহরে আমার বাস। এক শহর থেকে আরেক শহরে নিরন্তর আসা-যাওয়া। আরেকটা জায়গা পোলটাভা অঞ্চলের ছোট্ট শহর খোরল। আমার শৈশবের সোনালি দিনগুলোর অর্ধেকটাই কেটেছে এই শহরে। আমার প্রিয় বাবা-মা এখানেই থাকেন। আর তাই যখন আমি রুশ বিমান হামলার সতর্কতা তালিকায় আমার চির পরিচিত এই শহরগুলোর নাম দেখলাম, আমি ভয়ে শিউরে উঠলাম। মনে হলো, আমার পৃথিবীটা যেন ভেঙে-চুরে পড়ছে।
এখন প্রতিদিন প্রতিটি মুহূর্তে ইউক্রেনীয় শহরগুলোতে ক্ষেপণাস্ত্র আর গোলাবর্ষণ চলছে। আমাদের যা কিছুই ভালোলাগা ও ভালোবাসার, তার সব কিছুই ধ্বংস করছে রুশ বাহিনী। ওরা রক্তপিপাসু কাপুরুষ, রাতের বেলা হামলা চালাচ্ছে। আর দিন হলেই আমাকে পড়তে হচ্ছে কতজন মারা গেল, কতগুলো স্কুল-হাসপাতাল-বৃদ্ধাশ্রম ধ্বংস হলো। তবে এটা এখন পরিষ্কার, পুতিনের সব পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়েছে। তিন দিনে কিয়েভ দখল আর ১৪ দিন পশ্চিম ইউক্রেনে পৌঁছানোর ছক ভেস্তে গেছে। বিশেষ করে রুশ সেনাবাহিনী ‘পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম ও শক্তিশালী’ এসব মিথও ভেঙে পড়েছে। যুদ্ধক্ষেত্রে মার খেয়ে রুশ বাহিনী তাদের চিরাচরিত কর্মকাণ্ড শুরু করেছে। বেসামরিক নাগরিকদের ভয়ভীতি দেখাচ্ছে, আবাসিক এলাকায় গোলাবর্ষণ করছে। মানবিক করিডোরে নিরীহ মানুষের ওপর গুলি ছুড়ছে। সেই সব জায়গা টার্গেট করে ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ছে, যেখানে আমাদের নারী ও শিশুরা লুকিয়ে আছে। শহরগুলো অবরুদ্ধ করে মানবিক বিপর্যয় ঘটাচ্ছে। অধিকৃত এলাকায় মানুষকে অত্যাচার-নির্যাতন আর হত্যা করছে। কিন্তু এটা একুশ শতক। এমন ভয়াবহ সব অপরাধ করতে কেউ সহজেই পার পাবে না। আমরা নিশ্চয় করে জানি, পুতিন ও তার মানবতাবিরোধী অপরাধের সমর্থকদের এসব অপরাধের জন্য চরম মূল্য দিতে হবে। ইউক্রেনীয়দের কাছে পুতিনের উদ্দেশ্য পরিষ্কার। আগে হোক পরে হোক, প্রত্যেক স্বৈরশাসককেই একদিন তার নিজ দেশেই কঠোর পরিণতি বরণ করতে হয়।
হয় অর্থনীতি ধসে পড়ে। না হয় সীমাহীন মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণে নেতৃত্ব নিয়ে অনাস্থা তৈরি হবে। রাশিয়ার ক্ষেত্রে এসব সংকট আরও বহুগুণ। আর তাই নিজের ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে এমন একটি পথ বেছে নিয়েছেন যা সব স্বৈরশাসকেরই খুব পছন্দ। ‘একটা ছোট যুদ্ধ জয়’। কিন্তু চলমান এই যুদ্ধ পুতিনের জন্য মোটেও জয়ের হবে না। আমরা সত্যিকার অর্থে বিশ্বাস করি, যেই মুহূর্তে রুশ বাহিনী তাদের আগ্রাসন শুরু করেছে, তখনই তাদের লজ্জাকর পতন আরম্ভ হয়েছে। এই যুদ্ধে পুতিন তার নিজস্ব প্রপাগান্ডা বয়ান ধরে রাখতেই ব্যর্থ হয়েছে। তিনি ঘোষণা দিয়ে বলেছিলেন, ‘ইউক্রেনের রুশ ভাষাভাষি জনগণকে গণহত্যা থেকে বাঁচাতেই এই অভিযান।’
কিন্তু আসল বিষয় হচ্ছে, এই অভিযানে সেসব শহরই ধ্বংস হয়েছে যেসব শহরে বেশির ভাগই রুশ ভাষাভাষির বাস। এর দৃষ্টান্ত খারকিভ শহর। এই শহরের বেশির ভাগ মানুষই রুশ ভাষায় কথা বলত। এই শহর এখন একটা ধ্বংসস্তূপ। এই খারকিভের জনগণই এখন তাদের শহরের জন্য রুশ বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করছে। একই অবস্থা খেরসন, মারিউপোলসহ কিছু আরও শহরেরও। পুরো বিশ্বই এখন ইউক্রেনের পাশে দাঁড়িয়েছে। আমি চেরনিভৎসি শহরে বাস করি। শহরটি এখন ঘর হারাদের নতুন ঠিকানা হয়ে উঠেছে। প্রায় এক কোটি ইউক্রেনীয় তাদের ভিটেমাটি ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। যাদের মধ্যে ৫০ লাখ দেশ ছেড়েছে। অবশিষ্ট মানুষগুলো আমাদের পশ্চিমাঞ্চলের শহরগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে। তাদের যা কিছুই দরকার আমরা সাধ্যমতো দেওয়ার চেষ্টা করছি। বিশ্বের প্রতিটি দেশ যদি মানবিক সহায়তা নিয়ে এগিয়ে না আসত এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করা নিশ্চিতভাবেই আমাদের জন্য অনেক কঠিন হতো। আমি নিজেই এর সাক্ষী।
কারণ মাঝে মাঝেই শত শত টন নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস আনার জন্য সীমান্ত পেরিয়ে রোমানিয়া যাই। এ ক্ষেত্রে আমার সর্বশেষ অভিজ্ঞতা হচ্ছে, আমি হেটেই সীমান্ত পার হই এবং এরপর ত্রাণ বোঝাই গাড়ি নিয়ে ইউক্রেনে ফিরে আসি। এই যুদ্ধে আমাদের বিজয় অনিবার্য। কারণ সর্বশেষ জরিপ মতে, ৯৩ শতাংশ ইউক্রেনীয়ই মনে-প্রাণে বিশ্বাস করেন, যুদ্ধের ময়দানে ইতোমধ্যে আমরাই জয়ী।
Development by: webnewsdesign.com