দুই সপ্তাহ আগেও বিঘা প্রতি তরমুজ ক্ষেত বিক্রি হয়েছে দেড় লাখ টাকা। কিন্তু এখন তা মাত্র ২০ হাজার টাকা দর হাঁকছেন ক্রেতারা। এই ২০ হাজার টাকাও অনেকে ঠিকমতো পরিষোধ করছেন না। রমজান মাসে ৪০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হওয়া তরমুজ এখন পুরোটাও ৪০ টাকায় কিনতে চাচ্ছেন না কেউ।
ফলে খুলনার তরমুজ উৎপাদনকারীদের মাথায় হাত উঠেছে। অবস্থা এমন পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে যে পাওনাদারদের কারণে অনেক কৃষক এখন বাড়িতেও থাকতে পারছে না। পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে। বৃষ্টির কারণে তাদের অনেক কষ্টে উৎপাদিত তরমুজ এখন ক্ষেতেই নষ্ট হচ্ছে।
খুলনার দাকোপ, বটিয়াঘাটা ও কয়রা উপজেলার সম্ভাবনাময় এই কৃষি খাতটির অপমৃত্যু হতে চলেছে বলেও মন্তব্য করেছেন কৃষকরা।
কৃষি অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, গত বছর দাকোপে ৩৪০৭ হেক্টর জমিতে তরমুজ চাষ করে বিক্রি হয়েছিল প্রায় ১২০০ কোটি টাকায়। এ বছর সেই জমি বেড়ে দাঁড়ায় ৭৬০৫ হেক্টরে। বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা ছিল প্রায় ২০০০ কোটি টাকা। কিন্তু সেই আশা এখন নিরাশায় পরিণত হয়েছে। মাঠে মাঠে কৃষকের কান্না আর আহাজারিতে এলাকার পরিবেশ ভারী হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
তরমুজ চাষে বিপুল ক্ষতির শিকার দাকোপের কৃষক শেখ আবু সাঈদ, আনিসুর রহমান বাবুল, দেবু সরকার, শেখ কামরুজ্জামান ও মনিরুজ্জামান জানান, দাকোপের সদর চালনা, পানখালী এলাকাসহ ৩১, ৩২নং পোল্ডারের অধিকাংশ এলাকার চাষিদের কাঙ্ক্ষিত তরমুজের ফলন শেষ পর্যন্ত মোটামুটি ভালো হলেও ক্রেতা নেই।
শত শত বিঘার তরমুজ মাঠে গড়াগড়ি খাচ্ছে। আগামী ৫-৭ দিনের মধ্যে যদি কৃষকরা ক্ষেতের তরমুজ তুলতে না পারে তাহলে কোটি কোটি টাকার তরমুজ পচে নষ্ট হয়ে মাটির সঙ্গে মিশে যাবে।
কৃষকরা আরও জানান, শেষ রমজান পর্যন্ত মোটামুটি চাহিদা থাকায় বাজুয়া এলাকার তরমুজ দেদারছে বিক্রি হয়ে যায়। গোটা দাকোপ মিলিয়ে অবিক্রিত থাকে ৫৫ ভাগ তরমুজ ক্ষেত। ঈদের ২-৩ দিন পর হঠাৎ দরপতন ঘটে।
যেখানে বিঘা ১ লাখ ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা থেকে দেড়লাখ টাকায় বিক্রি হচ্ছিল সেখানে হঠাৎ করে আর কেউ ক্ষেত কিনতে চাচ্ছে না। বিঘাপ্রতি মূল্য মাত্র ২০-২৫ হাজার টাকা বলা হচ্ছে। কোনো কোনো জায়গায় আবার খরিদ্দারও নেই। দামও বলছে না।
তরমুজ নিয়ে মোকামে যাওয়া এক কৃষকের সঙ্গে মুঠোফোনে আলাপ হলে তিনি বলেন, আড়ৎদার বলেছে তরমুজ নিয়ে যেতে। তরমুজ আনার পর এখন বলছে, বাজারে দাম ভালো না তাই তরমুজ এখন চলবে না। জানি না আমরা কী করে বাঁচবো। বাড়িতে গেলে পাওনাদাররা বলবে তরমুজ বিক্রি করতে নিয়ে গেছ এখন আমাদের টাকা দাও।
বাজুয়া এলাকার কৃষক নিমাই গোলদার বলেন, দুই বিঘা জমিতে তরমুজ উৎপাদন করতে খরচ হয়েছে এক লাখ টাকার বেশি। সেই তরমুজ নিয়ে যশোর মোকামের আড়তে বিক্রি করতে হয়েছে মাত্র ৬০ হাজার টাকায়। যার মধ্যে পরিবহন খরচই হয়েছে ৫০ হাজার টাকা। সেই হিসাবে আমার ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৪০ হাজার টাকা।
তিনি বলেন, বিভিন্ন জনের কাছ থেকে লোনে টাকা নিয়ে তরমুজ চাষ করেছিলাম। এখন সেই টাকা কিভাবে পরিশোধ করবো বুঝতে পারছি না।
খুলনা মহানগরীর রেলস্টেশন এলাকার ফড়িয়া শামিম ও বাবুল বলেন, রোজার সময় চাষিরা প্রচুর দামে তরমুজ বিক্রি করেছে। যদি তারা সেই সময় একটু কম দামে বিক্রি করতো তাহলে তাদের সব তরমজু বিক্রি হয়ে যেতো। অধিক লাভের আশায় তারা তরমুজ ধরে রেখেছে। এখন তারা বিপদে পড়েছে।
খুলনা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অফিসের তথ্য অনুযায়ী, এ বছর জেলায় ১৩ হাজার ৯৯০ হেক্টর জমিতে তরমুজের আবাদ হয়েছে। সবচেয়ে বেশি দাকোপে ৭ হাজার ৬২৫ হেক্টর। বটিয়াঘাটায় ৩ হাজার ৬০০, পাইকগাছায় ১ হাজার ৫১০, কয়রায় ৮৯৫, ডুমুরিয়ায় ৩৫০, রূপসায় ৫, তেরখাদায় ৩ ও ফুলতলা উপজেলায় ১ ও শহরে আরও ১ হেক্টর জমিতে তরমুজের চাষ হয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের খুলনা জেলা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মো. হাফিজুর রহমান বলেন, প্রতি বিঘা জমির তরমুজ সাধারণত এক লাখ টাকায় বিক্রি হয়। উৎপাদন খরচ হয় ৩৫ থেকে ৪০ হাজার টাকায়। রমজান মাসে তরমুজের চাহিদা থাকলেও এখন সেই চাহিদা নেই। ফলে বাজারে তরমুজের দাম অনেকটা কমে গেছে। এতে করে অনেক কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
Development by: webnewsdesign.com