তদারকির অভাবে চরম বেহাল দশা বিরাজ করছে ময়মনসিংহের গৌরীপুর জংশন স্টেশন হয়ে মোহনগঞ্জ, জারিয়া ও ভৈরব-কিশোরগঞ্জ রেলওয়ে। তদারকি কর্মকর্তাদের পরিদর্শনের সেই নিয়ম পালন হচ্ছে শুধুমাত্র কাগজে-কলমেই। দীর্ঘদিন ধরে সংস্কার না করায় রেলওয়ের নড়বড়ে ‘রেলট্র্যাক’ (লাইন) ক্রমেই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ফলে হরহামেশায় ঘটছে লাইনচ্যুতির ঘটনা।
এদিকে গৌরীপুর রেলওয়ে জংশন স্টেশনের হোম সিগন্যালে চলতি সপ্তাহে একদিনের ব্যবধানে যাত্রীবাহী ও মালবাহী দুটি ট্রেন এবং উদ্ধারকারী রিলিফ ট্রেনের ইঞ্জিন লাইনচ্যুত হয়। এ দুর্ঘটনায় তদন্তে টিম গঠন হলেও এখন পর্যন্ত কোনো ধরনের কার্যকারী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। ফলে কখন ফের বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে তা নিয়ে রয়েছে এক ধরনের আতঙ্ক।
এ অবস্থায় গতকাল শনিবার সংলিষ্ট রেলওয়ের তিন কর্মকর্তাকে ঢাকায় তলব করা হয়েছে বলে জানা গেছে। তারা হলেন, রেলওয়ের সিএসএম আব্দুল কাদির, পয়েসম্যান ইসমাইল হোসেন ও সিগন্যাল খালাসি জেসমিন আরিফ তৌফিক।
একই দিনে বাংলাদেশ রেলওয়ের সহকারী পরিবহন কর্মকতা মো. রেজাউল করিমকে প্রধান করে তিন সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত টিম গঠন করা হয়েছে। তারা শনিবার দুপুরে ঘটনাস্থল তদন্ত করেছেন।
জানা যায়, গত বুধবার রাত পৌনে দশটার দিকে বিজয় এক্সপ্রেস চট্রগ্রাম যাওয়ার পথে গৌরীপুর জংশনে প্রবেশ করতেই ট্রেনটি লাইনচ্যুত হয়। এতে তিনটি বগির প্রায় পাঁচশতাধিক যাত্রী প্রানে বেঁচে যায়। এ অবস্থায় দীর্ঘ ৯ ঘণ্টা পর ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক হলেও এক দিনের ব্যবধানে গত শুক্রবার বিকেলে গৌরীপুর-ভৈরব রেলপথের হোম সিগন্যালে মালবাহী ট্রেনের কয়েকটি বগি লাইনচ্যুত হয়।
এ ঘটনায় প্রায় এক কিলোমিটার রেলপথ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ওই অবস্থায় চালক ট্রেনটি প্রায় আধা কিলোমিটার চালিয়ে নিয়ে যান। বগি লাইনচ্যুত হওয়ার দৃশ্য দেখতে পেয়ে স্থানীয় লোকজন চিৎকারে শুরু করে। পরে চালক ঘটনাটি টের পেয়ে ট্রেন থামান। থামানোর আগে মালবোঝাই বগিটি রেললাইনের স্লিপারের উপর দিয়ে হেঁচড়ে গিয়ে হোম সিগন্যালে এসে আটকে যায়। এতে রেললাইনের স্লিপারগুলো সরে গিয়ে দুমড়ে- মুচড়ে যায়। রেললাইনের কাঠের পাতগুলো সরে যায়।
স্থানীয় সূত্র মতে, ময়মনসিংহ-গৌরীপুর-ভৈরব ও জারিয়া-মোহনগঞ্জ রেলপথের বিভিন্নস্থানে পাথর না থাকা, মেয়াদ উত্তীর্ণ মরিচা ধরা ও ক্ষয়প্রাপ্ত রেললাইনে ট্রেন চলাচল করায় লাইনচ্যুতিসহ বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। আউটার সিগন্যাল পার হয়ে স্টেশনে প্রবেশের সময় ট্রেন অস্বাভাবিক রকম দুলতে থাকে। তখন যাত্রীদের মধ্যে মারাত্মক আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, রেললাইনের পাতের জয়েন্টে ৪টি নাটের জায়গায় আছে ২-৩টি। নাট-বল্টু না থাকায় জয়েন্টগুলো নেই ঠিকমতো। স্লিপার ভাঙা। স্লিপারের হুক খুলে পড়েছে। পাথরের পরিবর্তে স্লিপারের মধ্যখানে বালু দিয়ে রাখায় রেললাইনের নড়েবড়ে অবস্থা। শুধু গৌরীপুর জংশন আউটার সিগন্যাল এলাকাই নয় এ অঞ্চলের পুরো রেলপথজুড়েই রেললাইনে ক্লিপ, নাট, হুক, ফিসপ্লট, স্লিপার, গার্ডার বয়সের ভারে ন্যুব্জ। রেলপথে নির্মাণকৃত ব্রিজগুলো নির্মাণের পর থেকে এখন পর্যন্ত অধিকাংশ ব্রিজে কোনো মেরামত কাজ হয়নি। এর ফলে ব্রিজের উপরের রেললাইন রয়েছে চরম ঝুঁকিতে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই রেলপথের লাইনগুলো লাগানো হয় ৬০-৭০ বছর পূর্বে। দীর্ঘদিনের ব্যবহারে লাইনগুলো অত্যন্ত সরু ও মরিচা ধরে অনেক স্থানে ক্ষয় হয়ে মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়েছে বহু পূর্বে। এর ফলে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে যেকোনো সময়।
গৌরীপুর রেলওয়ে জংশন স্টেশন সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা-ময়মনসিংহ-চট্রগ্রাম, গৌরীপুর-ভৈরব, জারিয়া, নেত্রকোণা-মোহনগঞ্জ রেলপথে প্রতিদিন তিনটি আন্তনগর এক্সপ্রেস ও চার জোড়া লোকাল-মেইল ট্রেন চলাচল করে। গৌরীপুর জংশন স্টেশনের তিন দিকের আউটার সিগন্যালের মধ্যবর্তী দূরত্ব প্রায় পাঁচ কিলোমিটার। কিন্তু এই পাঁচ কিলোমিটার রেলপথে পাথর নাই বললেই চলে। কোনো স্থানে একটি দুটি পাথর আবার কোথাও একটি পাথরও নাই, মাটি ও ঘাসে স্লিপারগুলো ঢেকে গেছে। ট্রেন প্রবেশ করার পর থেকে দুই দিকে দুলতে থাকে। এতে যাত্রীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ফলে যেকোনো সময় বড় ধরনের ট্রেন দুর্ঘটনাসহ প্রাণহানীর আশঙ্কা রয়েছে।
এ বিষয়ে গৌরীপুরের বাসিন্দা কমরেড হারুন আল বারী বলেন, স্বাধীনতার পর এই ঐতিহ্যবাহী রেলওয়ে জংশনের কোনো ধরনের বড় সংস্কার হয়নি। এখানে গত কয়েক বছরে বেশ কয়েকটি ট্রেন দুর্ঘটনায় কবলিত হয়েছে। এ অবস্থায় দ্রুত ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক করলেও কি কারনে দুর্ঘটনা হলো তা প্রকাশ হয় না। ফলে অন্ধকারে থেকেই যায় আসল ঘটনা। এর জন্য দায়ী রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষরা।
এ ব্যাপারে কেবিন মাস্টার সাইদুর রহমান জানান, দুর্ঘটনা কবলিত সারবোঝাই মালবাহী ট্রেনের দুইটি বগি ডেমেজ হয়ে গেছে। অপরদিকে গৌরীপুরের রেলওয়ে স্টেশন মাস্টার আবদুর রশিদ জানান, এই জংশনের রেললাইনের অবস্থা অত্যন্ত খারাপ হয়ে গেছে। জরুরি সংস্কারের প্রয়োজন। বিশেষ করে রেলের পাথর সরে গেছে এমনকি লোকজন চুরি করে নিয়ে যায়। অন্যদিকে কাঠের অনেক স্লিাপার নষ্টের পথে।
তবে এ কথার সাথে দ্বিমত পোষণ করেছেন বাংলাদেশ রেলওয়ে ময়মনসিংহ অঞ্চলের সহকারী নির্বাহী প্রকৌশলী শুকুমার বিশ্বাস। তিনি বলেন, এসব ট্রেনের লাইনের ক্লিয়ারেন্স দেয় ক্যাবিনে (কন্ট্রোলরুম) দায়িত্বরতরা। তারা সঠিক সিগন্যাল দিলেই ট্রেন চলাচল করে। প্রথম দুর্ঘটনা হয় টু-রোডের কারণে। একলাইনে গাড়ি অর্ধেক যাচ্ছে আরেক লাইনে অর্ধেক। ক্যাবিনের লোকজন কাজে ফাঁকি দেওয়ায় এসব দুর্ঘটনা ঘটে। তারাই কাজে ফাঁকি দিচ্ছেন। এ ছাড়াও অনেক ট্রেনের অবস্থাও ভালো না। চাকা ও এক্সসেলের ত্রুটি আছে। সব মিলিয়ে এসব দুর্ঘটনা ঘটছে। তবে এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।
Development by: webnewsdesign.com