বাংলাদেশ ভাটির দেশ। হিমালয় থেকে নেমে আসা জলরাশি বাংলাদেশের ভূ-ভাগের ওপর দিয়ে সহস্র নদীর ধারায় ভাটির পথ প্রবহমাণ। এই ভাটির দেশেরই একটি ভাটি অঞ্চল সুনামগঞ্জ জেলা। যার দিরাই থানার উজানধল গ্রামের দক্ষিণ পাশ দিয়ে বয়ে গেছে কালনী নদী। কালনীর শ্রেষ্ঠ দান বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিম। এই বাউল সম্রাটের ১০৬তম জন্মবার্ষিকী আজ। ১৯১৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি কালনীর বুক ঘেঁষে টিকে থাকা উজানধল গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন।
আকাশ, মাটি, আলো, হাওয়া, জল সর্বোপরি প্রকৃতির আবেগ নিয়ে এদেশে হাজার বছরের বেশি বাংলা গানের যে ঐতিহ্য প্রবহমাণ রয়েছে। যাদের হাত ধরে এ জাতির এই ঐতিহ্য টিকে আছে শাহ আবদুল করিম তাদেরই অন্যতম একজন।কিংবদন্তী এই ভাবসাধক একাধারে সঙ্গীতশিল্পী, সুরকার, গীতিকার ও সঙ্গীত শিক্ষক। তিনি বাউল গানকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। কর্মজীবনে তিনি পাঁচশ’র উপরে গান রচনা করেছেন।
তার অনেক গানই আজো মানুষের মুখে মুখে চিরন্তন হয়ে আছে। ‘বন্দে মায়া লাগাইছে, পিরিতি শিখাইছে’, ‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম’, ‘গাড়ি চলে না’, ‘আমি কূলহারা কলঙ্কিনী’, ‘কেমনে ভুলিবো আমি বাঁচি না তারে ছাড়া’, ‘কেন পিরিতি বাড়াইলারে বন্ধু’, ‘সখী কুঞ্জ সাজাও গো’, ‘বসন্ত বাতাসে..সই গো/বসন্ত বাতাসে/বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ আমার বাড়ি আসে…’। এমন অসংখ্য জনপ্রিয় গানের স্রষ্টা শাহ আব্দুল করিম।
২০০৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর প্রয়াত হন এই বাউল সম্রাট। মৃত্যুর পর তার স্মৃতি সংরক্ষণে সরকারি কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। তবু তার ঘরে সংরক্ষিত বাদ্যযন্ত্র স্মারক, সনদ, সাধনা সামগ্রী, শয্যা এসব দেখতে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে অনুরাগী দর্শক প্রায় প্রতিদিনই ভিড় করেন।বাড়ির আঙ্গিণায় জরাজীর্ণ টিন শেডের ঘরের নীচে করিমের সমাধিক্ষেত্রটি আজো ভক্তদের কাছে প্রিয় দর্শণীয় স্থান হিসেবে বিবেচিত। এমনকি প্রতিবছর তাকে উপলক্ষ করে উজানধল গ্রামের মাঠে যে লোক উৎসব অনুষ্ঠিত হয় সেই রাস্তাটিও চলাচলের অনুপযোগি।
কিংবদন্তী এই বাউল সম্রাট জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি বিত্ত বৈভবহীন ছিলেন। বিষয় সম্পত্তির প্রতি তার কোন মোহ ছিল না। আজীবন দারিদ্রতার সঙ্গে লড়াই করেছেন। তিনি সতীর্থদের নিয়ে গাজীর গান, বাউলা গান, ঘাটু গান, পালাগান, সারিগান, মালজোড় গান, কবিগান সহ বিভিন্ন অতি প্রাকৃতজনের গান পরিবেশন করতেন। শাহ্ আব্দুল করিম রচিত বাউল, মুর্শিদী, জারিসারি, ভাটিয়ালি প্রভৃতি গান লোকমুখে বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে।
বাউল গবেষক ও সমাজসেবক আ ত ম সালেহ বলেন, ‘শাহ আব্দুল করিমের জীবন শুরু হয় রাখাল হিসেবে। কিছুদিন একটি মুদি দোকানের কর্মচারী হিসেবে কাজ করেন। উনার ছন্নছাড়া স্বভাবের জন্য সাধারণ মানুষের কথা তিনি ভাবতেন। তাদের দুঃখ কষ্ট তিনি সহ্য করতে পারতেন না। বাউলগানকে তিনি তার জীবনের ধ্যান ও জ্ঞান হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। সারা দিনমান মাঠে কষ্ট করার পরও তিনি ভাটি বাংলার বাউল গানের আসরে রাত জেগে গান পরিবেশন করতেন।’
মাত্র বিশ বছর বয়সে ‘আফতাব সঙ্গীত’ নামে তার প্রথম গানের বই প্রকাশ করেছিলেন। এ ছাড়াও গণসঙ্গীত, ভাটির চিঠি, ধলমেলা, কালনীর ঢেউ ও কালনীর কূলেসহ স্বরচিত গানের গীতিকথা নিয়ে ৬টি বই প্রকাশিত হয়েছে তার।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গেও বাউলসাধক শাহ আবদুল করিমের ঘনিষ্ঠতা ছিলো। হাওরাঞ্চলে বঙ্গবন্ধু যতবারই নির্বাচনী প্রচারণা কিংবা জনসভায় অংশ নিয়েছিলেন, ততবারই অবধারিতভাবে সঙ্গে ছিলেন শাহ আবদুল করিম। কখনো বক্তৃতার আগে, আবার কখনো বক্তৃতার পরে আবদুল করিম গণসংগীত পরিবেশন করে জনসভায় আগত ব্যক্তিদের চাঙা করতেন।
বঙ্গবন্ধুর লেখা অসমাপ্ত আত্মজীবনী থেকে জানা যায়, ১৯৪৭ সালে গণভোটের সময় তৎকালীন ছাত্রনেতা শেখ মুজিব দলবল নিয়ে সিলেটে এসেছিলেন। তবে সুনামগঞ্জে তিনি প্রথমবার এসেছিলেন ১৯৫৬ সালের ২৬ নভেম্বর। সে সময় তিনি দুর্নীতি দমন, বাণিজ্য, শ্রম ও শিল্প, পল্লি কৃষি ও শিল্প উন্নয়ন, সমাজ কল্যাণ এবং সমাজ উন্নয়ন পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত মন্ত্রী। ওই দিন বিকেলে শেখ মুজিব সুনামগঞ্জে আয়োজিত এক জনসভায় ভাষণ দেন। সে সমাবেশে অংশ নিয়েছিলেন শাহ আবদুল করিমও। করিম সে সভায় শেখ মুজিবকে নিয়ে স্বরচিত একটি গান পরিবেশন করেন। গানটি এমন:
‘পূর্ণচন্দ্রে উজ্জ্বল ধরা/চৌদিকে নক্ষত্রঘেরা/জনগণের নয়নতারা/শেখ মুজিবুর রহমান/জাগ রে জাগ রে মজুর-কৃষাণ॥’ এ গানই বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা প্রথম কোনো গান।
সেদিনের সমাবেশের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে শাহ আবদুল করিম তার আত্মস্মৃতিতে লিখেছেন: ‘গণসংগীত পরিবেশন করলাম যখন। /এক শত টাকা উপহার দিলেন তখন॥/শেখ মুজিব বলেছিলেন সৎ-আনন্দমনে:/আমরা আছি, করিম ভাই আছেন যেখানে।’
জীবদ্দশায়ই ২০০১ সালে শাহ আবদুল করিম একুশে পদক অর্জন করেন।
Development by: webnewsdesign.com