চীনে করোনা ভাইরাসে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছেই। এক দিনে মারা গেছেন ৮৬ জন। এখন পর্যন্ত সেখানে ৭২২ জনের মৃত্যু হয়েছে। আক্রান্তের সংখ্যা ৩৪ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। দুই দশক আগে চীনের মূল ভূখণ্ড এবং হংকংয়ে সার্স ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে মৃতের সংখ্যার কাছাকাছি চলে এসেছে করোনা ভাইরাসে মৃত্যু। ২০০২-০৩ সালে সার্সে বিশ্বব্যাপী ৭৭৪ জনের মৃত্যু হয়েছিল।
এদিকে রাশিয়া বলছে, করোনা ভাইরাস নিয়ে আমেরিকা ষড়যন্ত্র করছে। প্রাণ সংহারক করোনা ভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে এতদিন শুধু চীন থেকে আসা ব্যক্তিদের পরীক্ষা করা হলেও এখন তার পরিসর বাড়ানো হচ্ছে। বিশ্বের যে কোনো দেশ থেকে কেউ বাংলাদেশে ঢুকলে বন্দরে স্ক্রিনিংয়ের মধ্য দিয়ে যেতে হবে বলে জানিয়েছে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)। করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে উহানের একটি হাসপাতালে যুক্তরাষ্ট্রের এক নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে। ৬০ বছর বয়সি ঐ আমেরিকান জিনইনতান হাসপাতালে চিকিত্সাধীন ছিলেন। গত বৃহস্পতিবার সেখানেই তার মৃত্যু হয় বলে শনিবার বেইজিংয়ের যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের এক মুখপাত্র জানান। করোনা ভাইরাসের লক্ষণ নিয়ে উহানের হাসপাতালে ভর্তি হওয়া এক জাপানি নাগরিকের মৃত্যুর বিষয়টিও নিশ্চিত করেছে জাপানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ঐ জাপানি নাগরিকের দেহে করোনা ভাইরাস ছিল কি না—মৃত্যুর আগ পর্যন্ত পরীক্ষায় তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। চীনের বাইরে ২৭টি দেশে নিউমোনিয়া সদৃশ এ রোগে আক্রান্ত ৩৩২ জনের সন্ধান মিলেছে; এর মধ্যে ফিলিপাইনস ও হংকংয়ে দুই জনের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে।
মেলবোর্নের মোনাশ বিশ্ববিদ্যালয়ের রোগ সংক্রমণ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক অ্যালেন চেং বলেন, করোনা ভাইরাসটির সংক্রমণ কতটা বিষাক্ত তা বলা কষ্টকর। হিসাব অনুযায়ী আক্রান্তদের মধ্যে শতকরা দুই জনের মৃত্যু হচ্ছে দেখা গেলেও এখনো অনেক আক্রান্ত পরীক্ষার বাইরেই থেকে যেতে পারে।
অনেক দেশই তাদের নাগরিকদের চীন ভ্রমণের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। এছাড়া বিভিন্ন দেশ তাদের নাগরিকদের চীন থেকে ফিরিয়ে নিচ্ছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের এয়ারলাইন্স ইতিমধ্যেই চীনে তাদের ফ্লাইট বাতিল করছে। সেন্ট্রাল ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) এক মাসের বেশি সময় ধরে বিশেষজ্ঞদের একটি দলকে চীনে পাঠানোর প্রস্তাব দিয়ে আসছে। ঐ দলটিকে চীনে করোনা ভাইরাসের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ এবং প্রয়োজনে সহায়তা করতে পারবে; কিন্তু এখন পর্যন্ত চীনের তরফ থেকে কোনো ধরনের আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। কী কারণে চীন এমন করছে সে বিষয়টিও তারা ব্যাখ্যা করেনি। দুই সপ্তাহ আগে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও একই ধরনের প্রস্তাব দিয়েছে। এ ব্যাপারেও কোনো সাড়া মেলেনি। এ পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ায়, বেলজিয়াম, কম্বোডিয়া, কানাডা, ফিনল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, হংকং, ভারত, ইতালি, জাপান, ম্যাকাও, মালয়েশিয়া, নেপাল, রাশিয়া, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, স্পেন, শ্রীলঙ্কা, সুইডেন, তাইওয়ান, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইনস, সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র এবং ভিয়েতনামে এই ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
গতকাল শনিবার করোনা ভাইরাস পরিস্থিতি নিয়ে আইইডিসিআরের সাংবাদিক সম্মেলনে পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, চীন ছাড়াও আরো কয়েকটি দেশে স্থানীয়ভাবে একজনের দেহ থেকে আরেকজনে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে। এ কারণে বিমানবন্দরে আসা সব বিমানকেই স্ক্রিনিংয়ের আওতায় আনা হয়েছে। ঢাকার শাহজালাল বিমানবন্দরে থার্মাল স্ক্যানারের মধ্য দিয়ে যেতে হবে যাত্রীদের। তিনি বলেন, আসলে চীন এবং আরো কয়েকটি দেশের যাত্রীদের এই স্ক্রিনিং কার্যক্রমে আনলেই যথেষ্ট ছিল; কিন্তু আমরা অতিরিক্ত সতর্কতা হিসেবে এটা চালু করেছি। এটা সব দেশের ফ্লাইটের ক্ষেত্রেই শুরু হয়েছে।’ তবে এটা নিয়ে ভীত হওয়ার কিছু নেই মন্তব্য করে তিনি বলেন, এটা বাড়তি সতর্কতা।
বাংলাদেশের সবগুলো বন্দরে আসা যাত্রীদের স্ক্রিনিং করার সক্ষমতা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আছে কি না—এ প্রশ্নে অধ্যাপক ডা. ফ্লোরা বলেন, বিভিন্ন এয়ারলাইনস, বন্দর কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সহযোগিতায় এ কাজটি করা হচ্ছে। যে বন্দরে থার্মাল স্ক্যানার নেই, সেখানে আমরা হ্যান্ডহেল্ড স্ক্যানার দিয়েছি। থার্মাল স্ক্যানার এবং হাত দিয়ে যেটা করা হয়—দুটোর কার্যক্রম একই। চীন থেকে কেউ জ্বর না নিয়ে এলেও আসার ১৪ দিনের মধ্যে যদি কারও জ্বর আসে, তাদের আইইডিসিআরে যোগাযোগ করা বলা হচ্ছে। সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, শনিবার সকাল পর্যন্ত ৮ হাজার ৪৮৪ জনকে স্ক্রিনিং করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত ৫৩ জনের নমুনা পরীক্ষা করলেও কারো দেহে এন করোনা ভাইরাস পাওয়া যায়নি। চীনের উহান থেকে আসা ৩১২ বাংলাদেশির মধ্যে আশকোনা হজক্যাম্পে থাকা ৩০১ জনের সবাই সুস্থ আছেন। সিএমএইচে থাকা ১১ জনের অবস্থাও ভালো বলে জানান অধ্যাপক ডা. ফ্লোরা।
চীন থেকে আসা ছাত্র শ্বাসকষ্ট নিয়ে রংপুর মেডিক্যালে ভর্তি
করোনা ভাইরাস আতঙ্কে চীনের মা’আনশান আনহুই শহরের আনহুই ইউনিভার্সিটির সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ছাত্র তাসদিদ হোসেন তীব্র (২৪) গত ২৯ জানুয়ারি হজরত শাহজালাল বিমানবন্দর দিয়ে ফেরত আসেন। করোনা ভাইরাসের কোনো লক্ষণ না থাকায় বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ তাকে বাড়ি ফেরার অনুমতি দেয়। তার বাড়িতে নিয়মিত একটি মেডিক্যাল টিম পর্যবেক্ষণ করত। গতকাল সকালে তীব্র শ্বাসকষ্ট হলে তাকে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
তীব্র নীলফামারীর ডোমার উপজেলার মির্জাগঞ্জ এলাকার আলতাব হোসেনের ছেলে। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর হতে মির্জাগঞ্জ এলাকার মানুষদের মধ্যে করোনা ভাইরাস আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।
রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের অতিরিক্ত পরিচালক ডা. মোকাদ্দেম হোসেন জানান, তাকে আলাদাভাবে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা জানান, ঐ ছাত্রের শরীরে জ্বর নেই। লাংসও ভালো আছে। তবে শ্বাস নিতে তার কষ্ট হচ্ছে। তাই পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। ঢাকা থেকে টিম গিয়ে ঐ ছাত্রের পরীক্ষানিরীক্ষা করেছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ জানান, তাসদিদ হোসেন তীব্র রাতে ঘুমাতে পারে না। দম বন্ধ হয়ে আসে। এটা ভয় থেকে হতে পারে। তার কাশি, গলায় ব্যথা ও জ্বর নেই। প্রাথমিকভাবে করোনা ভাইরাসের লক্ষণ পাওয়া যায়নি। তবে রক্ত পরীক্ষা করে সবকিছু জানা যাবে।
করোনা ভাইরাস নিয়ে ভয়ের কিছু নেই :স্বাস্থ্যমন্ত্রী
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক এমপি বলেছেন, দেশে এখন পর্যন্ত করোনা ভাইরাসের কোনো রোগী শনাক্ত হয়নি। তাই এটি নিয়ে ভয়ের কিছু নেই। শুক্রবার বিকালে মানিকগঞ্জ জেলার সাটুরিয়া উপজেলার রাধানগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নতুন ভবনের ভিত্তিপ্রস্তুর স্থাপন শেষে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
চীন থেকে হংকং গেলে ১৪ দিন বন্দি থাকতে হবে
করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে নতুন নীতি অনুসরণ করছে হংকং। চীনের মূল ভূখণ্ড থেকে আসা যে কোনো ব্যক্তিকে ১৪ দিন কোয়ারেন্টাইন বা পৃথক স্থানে রাখা বাধ্যতামূলক করেছে দেশটি। আর হংকংয়ের অধিবাসীরা চীন থেকে নিজ দেশে ফিরে এলে তাদেরকে দুই সপ্তাহ নিজ নিজ ঘরের ভেতরে অবস্থান করতে হবে। এ নিয়ম ভঙ্গ করলে জেল-জরিমানারও বিধান রাখা হয়েছে। এ পর্যন্ত হংকংয়ে ২৬ জনের দেহে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের তথ্য নিশ্চিত করেছে দেশটির স্বাস্থ্য বিভাগ।
Development by: webnewsdesign.com