গত বছরের ৭ অক্টোবর থেকে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় নির্বিচারে আগ্রাসন চালাচ্ছে দখলদার ইসরায়েল। দীর্ঘ এই মাসেরও বেশি সময় ধরে চলা যুদ্ধে প্রায় ৩৫ হাজার ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে ইহুদিবাদী সেনারা, যার ৭০ শতাংশই নারী ও শিশু। আহত হয়েছেন আরও সাড়ে ৭৮ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি। ইসরায়েলি বাহিনীর বর্বরতায় ইতোমধ্যে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে গোটা গাজা উপত্যকা। এখন অভিযান শুরু করেছে গোটা উপত্যকা থেকে আশ্রয় নেওয়া ভূখণ্ডটির সর্ব দক্ষিণের মিশর সীমান্তবর্তী শহর রাফায়, যা বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবিরে পরিণত হয়েছে। এতে সেখানে বহু সংখ্যক বেসামরিক মানুষের মৃত্যুর আশঙ্কা করা হচ্ছে। রাফায় বেসামরিক মানুষের প্রাণহানির আশঙ্কায় ইতোমধ্যে ইসরায়েলে ভারী অস্ত্রের চালান স্থগিত করেছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন। এর মধ্যে বাংকারবিধ্বংসী বোমাও ছিল। দীর্ঘদিন ধরেই দেশটিতে অস্ত্র সরবরাহের সবচেয়ে বড় ও নির্ভরযোগ্য উৎস ওয়াশিংটন। ইসরায়েলকে অস্ত্রদাতাদের তালিকায় রয়েছে ইউরোপের জার্মানি, ইতালি ও যুক্তরাজ্যও। তবে কানাডা ও নেদারল্যান্ডস চলতি বছর ইসরায়েলে অস্ত্রের চালান পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছে। দেশ দুটির আশঙ্কা, বৈশ্বিক মানবিক আইন উপেক্ষা করে গাজায় বেসামরিক মানুষের ওপর তাদের পাঠানো অস্ত্র ব্যবহার করতে পারে ইসরায়েলি বাহিনী।
কোন দেশ ইসরায়েলকে কেমন ও কত অস্ত্র সরবরাহ করে?
আমেরিকা
মার্কিন কর্মকর্তাদের মতে, ইসরায়েলে স্থগিত করা অস্ত্রের চালানে ১,৮০০ ২,০০০ পাউন্ড বোমা ও ১,৭০০ ৫০০ পাউন্ড বোমা ছিল। এসব বোমার মূল্য লাখ লাখ ডলার। এক কর্মকর্তা বলেন, ২০০০ পাউন্ডের বোমার ব্যবহার জনবহুল রাফায় মারাত্মক প্রভাব তৈরি করতে পারে। এ আশঙ্কা থেকে অস্ত্রের চালান স্থগিত করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে কোটি কোটি ডলারের অস্ত্রশস্ত্র ইসরায়েলে সরবরাহের অপেক্ষায় রয়েছে। এর মধ্যে ট্যাংকের গোলাসহ অন্যান্য গোলাবারুদ রয়েছে। ২০১৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ইসরায়েল যে পরিমাণ সামরিক সহায়তা পেয়েছে, তার ৬৯ শতাংশ সরবরাহ করেছে ওয়াশিংটন। স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এসআইপিআরআই) এ তথ্য জানিয়েছে। ইনস্টিটিউট বলছে, ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল তৃতীয়বারের মতো ১০ বছর মেয়াদের একটি সমঝোতা স্মারক সই করে। এতে ২০১৮ থেকে পরের ১০ বছরে ইসরায়েলকে ৩৮ বিলিয়ন ডলারের সামরিক সহায়তা, ৩৩ বিলিয়ন ডলারের সামরিক সরঞ্জাম ও ৫ বিলিয়ন ডলারের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা দেওয়ার অঙ্গীকার করে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রে নির্মিত এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান ব্যবহার করে থাকে ইসরায়েল। প্রথম আন্তর্জাতিক মিত্র হিসেবে একমাত্র ইসরায়েল এ যুদ্ধবিমান ব্যবহারের সুযোগ পায়। বিশ্বের অন্যতম সর্বাধুনিক যুদ্ধবিমান এটি। এছাড়া সহায়তার অর্থে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ৭৫টি এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান কিনছে ইসরায়েল। ইতোমধ্যে ৩৬টি সরবরাহ করা হয়েছে। ইসরায়েলের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা আয়রন ডোমের আধুনিকায়নেও সহায়তা করছে ওয়াশিংটন। ২০০৬ সালে লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর সঙ্গে যুদ্ধের পর এটার আধুনিকায়ন শুরু করে ইসরায়েল।
জার্মানি
ইসরায়েলে ২০২৩ সালে ৩৫১ মিলিয়ন ডলারের প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম রফতানি করেছে জার্মানি, যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় ১০ গুণ। গত ৭ অক্টোবর গাজায় হামলা শুরুর পর ইসরায়েলকে সামরিক সহায়তা দেওয়ার অনুমোদনে অগ্রাধিকার দিয়েছে বার্লিন। চলতি বছরের শুরু থেকে গাজা যুদ্ধ নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে তুমুল সমালোচনার মুখে দেশটিতে অস্ত্র রফতানির অনুমোদন কমিয়ে আনার চেষ্টা দেখা গেছে জার্মানিতে। গত ১০ এপ্রিল জার্মানির অর্থ মন্ত্রণালয় পার্লামেন্টে জানিয়েছে, চলতি বছরের শুরু থেকে ইসরায়েলে সাকল্যে ৩২ হাজার ৪৪৯ ইউরোর অস্ত্র সরবরাহের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এসআইপিআরআই বলছে, ২০১৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ইসরায়েল যে পরিমাণ সামরিক সহায়তা পেয়েছে, তার ৩০ শতাংশ সরবরাহ করেছে জার্মানি।
ইতালি
ইতালির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানিয়েছে, গাজায় ইসরায়েল হামলা শুরু করার পর থেকে দেশটিকে অস্ত্র সরবরাহের নতুন প্রস্তাবগুলোর অনুমোদন স্থগিত রাখা হয়েছে। ওই সূত্র জানায়, এখন সবকিছু (অস্ত্রশস্ত্র পাঠানো) বন্ধ আছে। গত নভেম্বরে ইসরায়েলে অস্ত্রের সর্বশেষ চালান পাঠিয়েছে রোম। যুদ্ধরত কোনও দেশ কিংবা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন লঙ্ঘন করার আশঙ্কা রয়েছে— এমন কোনও দেশে অস্ত্র রফতানি ইতালির আইনে নিষিদ্ধ। ইতালির প্রতিরক্ষামন্ত্রী গুইদো ক্রসেত্ত গত মার্চে বলেছিলেন, ইসরায়েলে অস্ত্র পাঠিয়েছে ইতালি। তবে গাজা উপত্যকায় বেসামরিক মানুষের ওপর সেসব অস্ত্র ব্যবহার করা হবে কি না, তা নিশ্চিত হওয়ার পর শুধু আগে সই করা আদেশে অস্ত্র সরবরাহ করা হয়েছে। গত ডিসেম্বরেও ১৩ লাখ ইউরোর অস্ত্র ইসরায়েলে রফতানি করেছে ইতালি। ২০২২ সালের একই মাসের তুলনায় এটা তিন গুণ। এসআইপিআরআই বলছে, ২০১৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ইসরায়েল যে পরিমাণ সামরিক সহায়তা পেয়েছে, তার দশমিক ৯ শতাংশ সরবরাহ করেছে ইতালি। এর মধ্যে হেলিকপ্টার ও নৌবাহিনীর জন্য কামান রয়েছে।
ব্রিটেন
ইসরায়েলে রফতানি হওয়া অস্ত্রের বড় উৎস নয় যুক্তরাজ্য। দেশটির সরকার ইসরায়েলকে সরাসরি অস্ত্র দেয় না। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলোকে অস্ত্র বিক্রির লাইসেন্স দেয়। যুক্তরাজ্য গত বছর কোম্পানিগুলোকে অন্তত ৫২ দশমিক ৫ মিলিয়ন ডলারের প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম ইসরায়েলে রফতানি করার অনুমোদন দেয়। এর মধ্যে গোলাবারুদ, অজ্ঞাত আকাশযান, ছোট আকারের ও বহনযোগ্য গোলা এবং যুদ্ধবিমান, হেলিকপ্টার ও রাইফেলের সরঞ্জাম রয়েছে। গত বৃহস্পতিবার যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক দেশটির পার্লামেন্টে বলেন, অস্ত্র রফতানির অনুমোদনে বিশ্বের অন্যতম কঠোর নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা অনুসরণ করে থাকে যুক্তরাজ্য। সেই সঙ্গে দেশটি মানবিক আইনের প্রতি ইসরায়েলের প্রতিশ্রুতির বিষয়টি সময়ে সময়ে পর্যালোচনা করে। সূত্র: রয়টার্স
Development by: webnewsdesign.com