প্রতিদিন রাজধানীর ধলপুর সিটি করপোরেশন কলোনির লেক পাড়ে হাঁটতে বের হন মাহমুদুর রহমান আনসারি। একদিন হাঁটতে গিয়ে দেখলেন কিছু লোক বিনামূল্যে ডায়াবেটিস পরীক্ষা করছে, লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে লোকজন নিজেদের ডায়াবেটিস পরীক্ষা করাচ্ছেন।
তিনিও নিজের রক্ত পরীক্ষা করালেন এবং পরীক্ষক তাকে জানালেন লো ফ্যাট যুক্ত ‘মার্কস ডায়েট’ দুধ খেলে পুষ্টি চাহিদা পূরণের পাশাপাশি ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকে।
তাদের কথা শুনে তিনি এবং তার এক বন্ধুর জন্য দু প্যাকেট দুধ কিনে নেন। এটা ছিল গত শনিবারের ঘটনা। যেখানে সকালে যারা হাঁটতে বের হন তাদেরকে লক্ষ্য করে আবুল খায়ের গ্রুপের একদল বিক্রয় প্রতিনিধি এভাবে দুধ বিক্রি করেন।
মাহমুদুর রহমান আনসারি বলেন, ‘আমার ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, ওরা পরীক্ষা করে বললো মার্কস ডায়েট দুধ খেলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকে। তাই দু প্যাকেট দুধ কিনেছি।
ওই লেকপাড়ে টাঙানো কয়েকটি ব্যানারে দেখা গেল মার্কস দুধ নিয়ে নানা ধরণের প্রচারণা। একটি ব্যানারে লেখা রয়েছে, ‘মার্কস ডায়েট দুধ ৯৯ শতাংশ ফ্যাট ফ্রি। মার্কস দুধ ‘milk Based Diabetic Diet’ দুধের পুষ্টি সমৃদ্ধ Low GI ডায়েট। জি আই ফরমুলার কারণে রক্তে গ্লুকোজ ধীরে ধীরে রিলিজ করে, ফলে ব্লাডে সুগার লেভেল দ্রুত বাড়ে না।’
আরেকটি ব্যানারে বলা হয়েছে ‘মার্কস ডায়েট দুধের পুষ্টিগুণ থাকে পুরোটাই, থাকে না শুধু মোটা হয়ে যাওয়ার ভয়’ কিন্তু নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের মোড়কাবদ্ধ খাদ্য লেবেলিং বিধানমালা ২০১৭তে বলা হয়েছে ভিন্ন কথা।
বিধানমালার ৪ ধারার ৭ উপধারায় বলা আছে, ‘লেবেলে ‘চিকিৎসক, বিশেষজ্ঞ বা সমতুল্য কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সুপারিশকৃত’ ধরনের কোনো অভিব্যক্তি প্রকাশ বা ঘোষণা করা যাবে না, থেকে ক্রেতা বিভ্রান্ত হইতে পারে’
উপধারা ৮ এ বলা আছে, ‘খাদ্য বা খাদ্য পণ্যের গুরুত্ব বৃদ্ধি করিতে উহার পরিমাণ ও পুষ্টিগুণের বিষয়ে লেবেলে কোনো মিথ্যা তথ্য, দাবি বা অপকৌশল অথবা ‘রোগ নিরাময়কারী, ইত্যাদি ধরনের কোনো বিভ্রান্তিকর তথ্য বা দাবি এবং উৎসস্থল সম্পর্কে কোনো বিভ্রান্তিকর বক্তব্য লিপিবদ্ধ করা যাবে না’
সিটি করপোরেশন স্যানিটারি ইন্সপেক্টর বা নিরাপদ খাদ্য পরিদর্শকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ‘একটি প্রতিষ্ঠান শুধু তাদের পণ্যের মধ্যে কি ধরণের উপাদান রয়েছে তা বলতে পারবে। তবে এটি খেলে কী হবে তা নিয়ে কোনো ডাক্তার বা বিশেষজ্ঞ মতামত দিতে পারবে না। আইনিভাবে এটা একটি অপরাধ’
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নিরাপদ খাদ্য পরিদর্শক কামরুল হাসান বলেন, ‘উপাদান কী আছে সেটা বলা যাবে, কিন্তু খেলে কী হবে তা কোনো পণ্যের প্রচারণায় বলা যাবে না।
এই ধরনের প্রচারণার কারণে কোম্পানিটির বিরুদ্ধে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন বিশুদ্ধ খাদ্য আদালতে একটি মামলা চলমান রয়েছে, কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি এখনো শোধরায়নি বলে জানান তিনি।
জানা গেছে, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের মোড়কাবদ্ধ খাদ্য লেবেলিং বিধানমালা না মেনে আবুল খায়ের গ্রুপের পণ্য মার্কস দুধের বিজ্ঞাপন, প্রচারণা ও বিক্রি অব্যাহত রয়েছে, যা মূলত গ্রাহকের সঙ্গে প্রতারণা ও আইনের লঙ্ঘন। মুনাফার লোভে এ ধরনের মিথ্যা বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রচারণা চালাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।
২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে সিটি করপোরেশন বিশুদ্ধ খাদ্য আদালতে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য আইন, ২০১৩তে নিরাপদ খাদ্য পরিদর্শক কামরুল হাসান বাদী হয়ে একটি মামলা দায়ের করেন।
তবে একটি শুনানির পর আবুল খায়ের গ্রুপের আইনজীবী বিশুদ্ধ খাদ্য আদালতে ন্যায়বিচার পাবে না বলে জানায়। পরে মামলাটি পরিচালনার জন্য হাইকোর্টে নেওয়া হয়। সম্প্রতি হাইকোর্ট থেকে আবারও মামলাটি পরিচালনার জন্য বিশুদ্ধ খাদ্য আদালতে পাঠানো হয়, যেখানে মামলার শুনানির তারিখ রয়েছে আগামী ২৩ জানুয়ারি।
আবুল খায়ের গ্রুপের একজন ম্যানেজার মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘মামলা হওয়ার পরই আমরা আমাদের বিজ্ঞাপনগুলো পরিবর্তন করেছি। এখন আর কোনো সমস্যা নেই।’
তবে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকে এমন প্রচারণা করে দুধ বিক্রি হচ্ছে বলে তাকে জানানো হলে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা ছিল না, এ ধরনের কিছু ঘটে থাকলে আমরা ব্যবস্থা নেব।’
Development by: webnewsdesign.com