অস্থির তেলের বাজার

বুধবার, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২ | ১২:০৫ অপরাহ্ণ

অস্থির তেলের বাজার
apps

কয়েক মাস ধরেই বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম ঊর্ধ্বমুখী। জ্বালানি তেলের বাজারকে আরও উত্তপ্ত করে তুলেছে রাশিয়া-ইউক্রেন সঙ্কট। রাশিয়া পূর্ব ইউক্রেনের রুশপন্থি দুটি বিচ্ছিন্নতাবাদী অঞ্চলকে স্বাধীন হিসেবে ঘোষণার পর মঙ্গলবার বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য গত সাত বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। ব্যারেলপ্রতি দাম উঠেছে প্রায় ৯৯ মার্কিন ডলারে। জ্বালানি তেলের মূল্যে হঠাৎ এত উল্লম্ফনে আতঙ্ক বাড়ছে দেশেও। বিশেষ করে সাধারণ মানুষ ও শিল্প-উদ্যোক্তারা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন- দেশের বাজারেও আবার দাম বৃদ্ধি পায় কি না।

তবে বিশ্ববাজারে দাম বাড়লেও হুট করেই দেশের বাজারে জ্বালানি তেলের দাম না বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন শিল্প-উদ্যোক্তা, অর্থনীতিবিদ ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, মাত্র তিন মাস আগে দেশের বাজারে লিটারপ্রতি ডিজেলের দাম ১৫ টাকা বাড়ানো হয়েছে। সে ধাক্কাই এখনও সামলানো যায়নি, এর মধ্যে আবারও দাম বাড়ানো হলে তা দেশের মানুষের জন্য অসহনীয় পর্যায়ে চলে যাবে।

এ বিষয়ে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর সভাপতি জসিম উদ্দিন মঙ্গলবার বলেন, ‘বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়লেও হুট করেই যেন দেশের বাজারেও দাম বাড়ানো না হয় এবং সেটি কোনোভাবেই যুক্তিসঙ্গত হবে না। কারণ এখন বিশ্ববাজারে দাম বাড়লেও এই বর্ধিত মূল্যের তেল দেশের বাজারে আসতে সময় লাগবে ২ থেকে ৩ মাস। এ ছাড়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ পর্যন্ত নাও হতে পারে। দেখা গেল বিশ্বনেতাদের প্রচেষ্টায় যুদ্ধ থেমে গেল, সুতরাং তেলের দাম কমেও যেতে পারে। তাই এখন যেটুকু দাম বেড়েছে তার প্রভাব দেশে পড়তে অন্তত তিন মাস সময় লাগবে- বিষয়টি যেন বিবেচনায় রাখা হয়।’

বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির কথা বলে গত ৩ নভেম্বর লিটারে ১৫ টাকা করে বাড়ানো হয় ডিজেল ও কেরোসিনের দাম। ভোক্তা পর্যায়ে দাম ৬৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৮০ টাকা করা হয়, যা ওই দিন রাত ১২টা থেকেই কার্যকর হয়। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সেদিন দাম বৃদ্ধির তথ্য জানিয়ে আরও বলা হয়, বর্তমান ক্রয়মূল্য বিবেচনা করে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) প্রতি লিটার ডিজেল ১৩ দশমিক ১ টাকা কমে বিক্রি করছে। অপরদিকে ফার্নেস অয়েল বিক্রি করা হচ্ছে লিটারপ্রতি ৬ দশমিক ২১ টাকা কমে। এতে প্রতিদিন প্রায় ২০ কোটি টাকা লোকসান দিচ্ছে বিপিসি। অক্টোবর মাসে বিভিন্ন গ্রেডের পেট্রোলিয়াম পণ্য বর্তমান দামে সরবরাহ করায় বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের মোট ৭২৬ কোটি ৭১ লাখ টাকা লোকসান হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম পুনর্নির্ধারণ করা হয় সে সময়। অবশ্য এর আগে সর্বশেষ ২০১৬ সালের ২৪ এপ্রিল গেজেটের মাধ্যমে পেট্রোলিয়াম পণ্যের দাম কমানো হয়েছিল।

আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম থেকে জানা গেছে, ইউক্রেন উত্তেজনায় এরই মধ্যে জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে। যাকে কেন্দ্র করে অনেক দেশেই মূল্যস্ফীতি দেখা যাচ্ছে। ইউক্রেন উত্তেজনা প্রশমিত না হলে শুধু জ্বালানি তেলের বাজারেই নয়, গোটা বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রভাব পড়বে। এর আগে ২০১৪ সালে রাশিয়া ক্রিমিয়া দখল করলে তখনও বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম অস্বাভাবিক বেড়েছিল।

এদিকে ইউরোপের দেশগুলো (বিশেষ করে পূর্ব ইউরোপ) চাহিদার ৩৫ শতাংশ প্রাকৃতিক গ্যাসের জন্য রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল, যার অধিকাংশই পাইপলাইনের মাধ্যমে বেলারুশ ও পোল্যান্ড হয়ে জার্মানিতে যায়। বাকিটা যায় ইউক্রেন হয়ে। উত্তেজনা চরমে পৌঁছালে এই গ্যাস পাইপলাইনগুলো বন্ধ হয়ে যাবে। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি জো বাইডেন ঘোষণা দিয়েছেন, রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করলে বাল্টিক সাগরের নিচ দিয়ে রাশিয়া থেকে সরাসরি জার্মানিতে গ্যাস সরবরাহের যে পাইপলাইন প্রস্তুত হচ্ছে তা বন্ধ করে দেওয়া হবে।

বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন এই প্রতিবেদককে মঙ্গলবার বলেন, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্যে এরই মধ্যে প্রভাব ফেলেছে ইউক্রেন ইস্যু। এখনই ব্যারেলপ্রতি ১০০ মার্কিন ডলার হয়েছে। উত্তেজনা না থামলে সামনে কী হবে তা অনুমানের বাইরে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, রাশিয়া ইউক্রেনে আক্রমণ চালালে যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবে। নিষেধাজ্ঞা এলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে। তখন গোটা বিশ্বকেই চলমান উত্তেজনার নেতিবাচক প্রভাব পোহাতে হবে।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো এবং অর্থনীতি বিশ্লেষক ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য মঙ্গলবার এই প্রতিবেদককে বলেন, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দামের পরিস্থিতি খুব ভয়াবহ। এমনিতেই কোভিডের কারণে সরবরাহ প্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটায় এবং শীতকালের কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে জ্বালানি তেল নেতিবাচক পরিস্থিতি মোকাবিলা করছিল। কিন্তু কোভিডের ধাক্কা সামলিয়ে যখন বিশ্ব অর্থনীতি গা-ঝাড়া দিয়ে উঠছিল, তখন ইউক্রেন উত্তেজনা আবারও জ্বালানি তেলের মূল্যে প্রভাব ফেলছে। এখন ইউক্রেন উত্তেজনায় যদি জ্বালানি তেলের সরবরাহে সামনে আরও বিঘ্ন ঘটে তবে দাম আরও বাড়বে।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর এই প্রতিবেদককে বলেন, ইউক্রেন উত্তেজনায় বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য কোথায় গিয়ে ঠেকে তা অনুমান করা কঠিন। তবে আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সংস্থাগুলো জানিয়েছে, তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ১০০ মার্কিন ডলারে পৌঁছতে পারে। তবে উদ্যোক্তারা কোনোভাবেই এখন দেশের বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির পক্ষে নন।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, বর্তমান যে মূল্যে জ্বালানি তেল ও গ্যাস কিনতে হচ্ছে তারই বিল দিতে পারছেন না অনেক উদ্যোক্তা। অধিকাংশ কল-কারখানায় ডিজেলচালিত জেনারেটর চলে। সুতরাং ডিজেল বা অন্যান্য জ্বালানি তেলের দাম নতুন করে বাড়ানো হলে মহাকেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। কারণ দাম বৃদ্ধির ফলে আমরা তো ভুগবই, দেশের সাধারণ মানুষও নিষ্পেষিত হবে। সুতরাং সরকারের উচিত হবে দাম আর না বাড়িয়ে এ খাতে ভর্তুকি বাড়ানো। আমরা জানতে পেরেছি, গত ১০ বছরে কোনো রকম বিদ্যুৎ উৎপাদন ছাড়াই বসে বসে বেশ কয়েকটি বিদ্যুৎ প্লান্টে ৭০ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে। অহেতুক এসব ভর্তুকি বন্ধ করে ডিজেল, কেরোসিনসহ জ্বালানি তেলে ভর্তুকি বাড়ানো হোক। তাহলের দেশের মানুষ কিছুটা স্বস্তি পাবে।

Development by: webnewsdesign.com